ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক

সাধারণভাবে স্বপ্নকে বলা হয়, মানুষের ভিতরকার চাহিদার অভিব্যক্তি। ঘুমন্ত অবস্থায় এবং অজান্তেই কিছু গল্প, বিনোদন, রোমান্স, ভয়ার্ত দৃশ্য সামনে আসে। মনোবিদদের মতে, প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতি রাতে তিন থেকে ছয়বার স্বপ্ন দেখেন। প্রতিটি স্বপ্ন পাঁচ থেকে ২০ মিনিট স্থায়ী হয়। তাদের মতে, ঘুম ভেঙ্গে গেলে ৯৫ ভাগ স্বপ্নই তারা ভুলে যান। তাদের মতে, অন্ধেরা নাকী বেশি বেশি স্বপ্ন দেখেন। বাংলার জনপদজুড়ে কত রকমের যে স্বপ্নের কথা বলা আছে, তা বলে কয়ে শেষ করা যাবে না। নানা রকমের স্বপ্ন বিলাস আছে- এই যেমন দিবা স্বপ্ন, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন, জেগে থেকে স্বপ্ন, স্বপ্নে রাজা বাদশা হয়ে যাওয়া, আকাশে উড়া, কুড়ে ঘরের আঙিনায় অট্রালিকা, ছিড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন, আরো কত কী। স্বপ্ন নিয়ে অনেক সাহিত্য ও গানও রচিত হয়েছে। অনেক সময় আবার স্বপ্ন ও ধর্ম এক জায়গায় হয়ে যায়। এদিকে আমাদের দেশে স্বপ্নকে সহজেই অন্ধবিশ্বাস ও গুজব বানিয়ে ফেলা যায়। যেমন স্বপ্নে দেখেছে পুকুরের জল খেলে সর্বপ্রকার রোগ নিরাময় হবে। আর যায় কোথায়- একদিনেই পুকুরের জল নি:শেষ। কেউ স্বপ্নে ঝোপের আড়ালে কোনো এক সাধুকে দেখেছেন- পরেরদিন মানুষের পদভাড়ে ঝোপ-জঙ্গল সাফ। প্রচলিত এসব স্বপ্ন ছাড়া আর একটি স্বপ্ন আছে- সেটা হলো সৃজনশীল স্বপ্ন। একটি পরিকল্পিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান হলো- স্বপ্নের গভীরে প্রবেশ করা। সেই পরিকল্পিত স্বপ্নই আজ বাস্তবে রূপলাভ হয়েছে- সেটাই হলো আজকের স্বপ্ন, বহুমুখী পদ্মা সেতু।

কোন স্বপ্নই বাস্তবায়িত হয় না যদি স্বপ্নের গভীরে প্রবেশ করা না যায়- স্বপ্নের সঙ্গে জাতির স্বপ্ন এক হয়ে না উঠে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে তাই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্বপ্নের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন। দেখেছিলেন গোটা জাতির স্বার্থকে। ফলে একজনের স্বপ্নের গর্ব হয়ে উঠেছে পুরো দেশের স্বার্থ, গর্ব। দৃঢ়তা, সৎসাহস এবং জাতির স্বার্থ এই সৃজনশীল স্বপ্নের মধ্যদিয়ে তিনি দেশকে আর একটি গৌরবের শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। জনগণের স্বার্থ ও সমর্থন জড়িত হলে অসম্ভব বলতে কিছু থাকে না। জনগণের অর্থায়নে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বিশ্বের কাছে আজ নজির হয়ে থাকলো।

আইফের টাওয়ার বললে বুঝি ফরাসি দেশ, স্টেচু অব লিবার্টি বললে আমেরিকা, মহাপ্রাচীর বললে বুঝি চীন দেশ, আর তাজমহলের দেশ বললে বুঝি ভারত। রোম নগরের স্থাপত্য শিল্প দেখার জন্য বিস্ময় নিয়ে পর্যটকরা ভ্রমন করছেন। মনে হয় অচীরেই বিশ্ব সম্প্রদায় বলবে, পদ্মা সেতুর দেশ- বাংলাদেশ। আমাজন নদীর পরেই এই খর স্রোতা পদ্মার উপর নির্মিত সেতু ঘিরে গড়ে উঠবে একটি পর্যটন শিল্প- একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। নির্মাণের প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পর্কে ব-কলম হলেও এর কারিগরি দিক দেখে-শুনে মনে হয়েছে- একদিন এই পদ্মা সেতু বিশ্বে সেতু নির্মাণের ইঞ্জিনিয়ারিং সিলেবাসে স্থান করে নিবে।

পদ্মা সেতু থেকে অর্থনৈতিক সুফল লাভ করতে হলে দেখতে হবে সেতুর সঙ্গে জড়িত অবকাঠামো। প্রসঙ্গক্রমে প্রথমেই বলা যায়- সেতু সুবিধার ফলে মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পাবে, যান বাহনের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘ ও কষ্টকর ভ্রমনের কারণে যারা পদ্মা পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবতেন না- তারা এখন চাইবেন উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, উচ্চশিক্ষাসহ নানা সুবিধা পেতে রাজধানীতে আসতে। তাতে করে রাজধানীর উপর অত্যাধিক চাপ বাড়বে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে যান বাহন। যানজঠে ঢাকাবাসী এমনিতেই অতিষ্ঠ। সঙ্গে ২১টি জেলার মানুষ ও যানবাহনের বাড়তি চাপ বিবেচনায় এনে মোকাবেলা করার জন্য রাজধানীর অবকাঠামো তেমন বাড়েনি। এই বিষয়টি জরুরিভাবে এখন সামনে এসেছে- তাই দেখতে হবে জরুরিভাবেই।

শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা ঘিরে সেতুকে দেখলে চলবে না। এর সুফল এবং অর্থনীতিকে তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ পযর্ন্ত আমলে রাখতে হবে। এই পদ্মা সেতুকে ঘিরে যদি একটি অর্থনীতির যজ্ঞস্থান হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে দেশের পরিবহন অবকাঠামোকে সহজ করতে হবে। যাতে করে দেশীয় পর্যটকগণ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারেন। যে কোনো বৃহৎ স্থাপনা থেকে খরচ তুলে আনার একটি শর্ত হলো- তার সঙ্গে যুক্ত অবকাঠামো। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। এই বিনিয়োগ উঠে আসতে কত বছর সময় লাগবে তা এখনই সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে হিসাবের খাতায় মূলধন উঠে আসার সঙ্গে অবশ্যই দেখাতে হবে এই বিশাল অর্থ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত করে রাখলে সরকার বছরে কত সুদ পেতেন। দিনে কত লক্ষ্য টাকা টোল আদায় হলো, তার লভ্যাংশ কতো তার হিসাব কষতে হলেও দেখতে হবে সেতু সংশ্লিষ্টতায় দিনে খরচের খতিয়ান কত। খবরে বলা হয়েছে যে, প্রথমদিনে আট ঘন্টায় টোল আদায় হয়েছে ৮২ লাখ ১৯ হাজার ৫০ টাকা এবং প্রথম ২৪ ঘন্টায় মোট টোল ফি আদায় পরিমান ২ কোটি ৯ লাখ টাকা। এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্র মতে, চুক্তি অনুযায়ী সেতু কর্তৃপক্ষ, ৩৫ বছরে সুদসহ ৩৬ হাজার কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিশোধ করবেন। পদ্মা সেতুর চালু হওয়ার কারণে জাতীয় জিডিপিতে ১.২ শতাংশ যোগ হবে।

জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হলে বড় বড় স্থাপনা নির্মাণের বিকল্প নাই। পশ্চিমা দেশগুলোতে রয়েছে হাইওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে এবং নানা আকারের সেতু। টোল ফি দিয়ে যানবাহনকে হাইওয়ে প্রবেশ করতে হয়। আবার এক্সপ্রেসওয়ে ঢুকতে হলে নিদির্ষ্ট পরিমানে টোল ফি দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। এভাবেই সরকার সেবাদানের বিনিময়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন। পদ্মা সেতুকে নিয়ে সাধারণ মানুষের যে স্বাধীন উচ্ছাস ও উল্লাস- ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এমন স্বাধীনতা অবশ্যই কাম্য নয়। যেখানে সেখানে এলোমেলোভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পদ্মার দুই পাড় ঘিরে যতই পার্ক, হোটেল, শিল্প-কারখানা, আমদানি-রপ্তানি জোন গড়ে উঠুক না কেন- থাকতে হবে একটি পরিকল্পনা, দিক নির্দেশনা, একটি সুষ্ঠ নীতি। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রধান মন্ত্রী ও জড়িত ব্যক্তিদের ধন্যবাদ। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: