ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক।
বাংলাদেশের বৃহত্তর দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের বিসর্জিত এক মিশনারি আত্মা- ফাদার আঞ্জেলো মাজ্জীওনী, পিমে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট বর্তমান রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের আন্ধারকোটা ধর্মপল্লীর নিজ বাসভবনে ডাকাতদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। নিহত হওয়ার ২৫ বছর পর আন্ধারকোটা ধর্মপল্লীতে অন্তত ভাবগম্ভীর পরিবেশে ফাদার মাজ্জীওনীর নিহত হওয়ার রজত জয়ন্তী পালন করা হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট রোজ শনিবার। নিহত ফাদারের আত্মার কল্যাণে সকাল ন’টায় খ্রিস্টযাগ অর্পণ করা হয়। খ্রিস্টযাগে পৌরহিত্য করেছিলেন তখনকার রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও এবং তাকে সহায়তা দিয়েছিলেন আর্চবিশপ মাইকেল রোজারিওসহ আরো ১২জন যাজক। উপাসনার পরে সেদিন অনেকেই তাঁর স্মৃতিচারণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন ফাদার জন যদু রায়- তিনিও আজ জীবিত নেই।
২৫ বছরের সঙ্গে আরো ২৫টি বছর যোগ হয়ে ফা. আঞ্জেলো মাজ্জীওনীর নিহত হওয়ার সুবর্ণ জয়ন্তী, ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী। এতো বছর পর এখন তাঁর বিষয়ে স্মৃতিচারণ করার মতো লোক বা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন এমন লোক পাওয়া একটু কঠিন হবে। অনেকে ভুলেও গিয়েছেন তিনি এক সময় আন্ধারকোটা মিশনে কাজ করেছেন এবং এখানেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। নিজ ঘরের মধ্যে দেয়ালে ও আলমারিতে গুলির চিহ্ন আজো শহীদের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
ফাদার মাজ্জীওনীর কর্মজীবন: সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে তিনি এসেছিলেন অমৃত্যের সন্ধানে নয়- কিন্তু অমৃত বিলাতে; আর সত্যি সত্যিই বিলিয়ে গেলেন সবটুকু নীরবে, নিঃশেষিত হয়ে। এই দেশের মাটি-মানুষকে ভালোবেসে যেমন মাতৃভূমি ছেড়েছিলেন- সেই ভালোবাসায় রয়ে গেলেন এদেশের মাটিতেই। আন্ধারকোটা গির্জাঘরের মধ্যেই রয়েছে তাঁর সমাধি। জীবনকালে ভোরের পাখির মতো আড়ালে থেকে বিলিয়েছিলেন কন্ঠসুধা- তেমনি জীবনাবসানে আজো আছেন ভালোবাসায়।
ফাদার আঞ্জেলো মাজ্জীওনী উত্তর ইটালির মিলান মহাধর্মপ্রদেশের ত্রেজ্জা দ্যা’আদ্দা নামক স্থানে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪জুন জন্মগ্রহণ করেন। আর নির্মমভাবে নিহত হোন ১৪ আগস্ট, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের আন্ধারকোটা (Our Lady of Perpetual Help Church) ধর্মপল্লীতে। ছাত্র জীবনে তিনি পিমে মিশনারি যাজক সম্প্রদায়ের চ্যালেঞ্জিং কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেমিনারিতে প্রবেশ করেন। তিনি মনে মনে ঠিক ক’রে রেখেছিলেন যে, যাজকত্ব লাভের পর মিশনারি হবেন। সেমিনারির পড়াশোনা শেষ হলে আঞ্জেলো মাজ্জীওনী মিলান মহাধর্মপ্রদেশে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর যাজকপদে অভিষিক্ত হোন। ইতিমধ্যেই গোটা ইউরোপজুড়ে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তাঁর দেশ ইটালিও জড়িয়ে পড়ে সেই মহাসমরে। ফলে ভেস্তে যায় বিদেশে মিশনারি হয়ে কাজ করার স্বপ্ন। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে নিয়ত প্রার্থনার ফলে প্রত্যাশার পথ চেয়ে থাকতে হয়নি এক যুগও। বৃটিশ শাসনের অবসান এবং পাকিস্তানি শাসনের এক বছরের বর্ষপূর্তির পরেই অর্থাৎ, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর পা রাখলেন পূর্ব বাংলার শ্যামল মাটি- দিনাজপুর। আর সেই থেকে তাঁর মিশনারি হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে এসে দাঁড়ালো।
ফাদার মাজ্জীওনী তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আগমনের পর তাঁর পালকীয় কাজ শুরু করেন দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের মারীয়ামপুর ধর্মপল্লীতে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে। তিনি মারীয়ামপুর থেকে তাঁর পালকীয় কাজ বিস্তৃত করেছিলেন- দিনাজপুর শহরের আশপাশ পর্যন্ত। অনেকে মনে করেন দিনাজপুর শহরলগ্ন সুইহারী ধর্মপল্লীর তিনিই আসল প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ পযর্ন্ত ভারতের পশ্চিম বাংলার মালদহ্ ও জলপাইগুঁড়ি জেলা ছিল দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের অধীনে। সেই সুবাদে ফাদার মাজ্জনীর পালকীয় কর্মক্ষেত্র ঐ দু’টি জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তিনি এক সময় দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপ্স্ হাইস্কুল ছাত্রাবাসের পরিচালক এবং ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত হিসেবেও কাজ করেছেন।
ফাদার মাজ্জীওনী বর্তমান দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশে ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ পযর্ন্ত বিভিন্ন দায়িত্বে পালকীয় কাজ করার পর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে বদলি হয়ে দক্ষিণাঞ্চল- তথা বর্তমান রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বনপাড়া ধর্মপল্লীতে আসেন। বনপাড়ায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পাল-পুরোহিত নিযুক্ত হওয়ার পরের বছরেই স্বর্গীয় ফাদার লুইজি ভেরপেল্লীর সহযোগিতায় গড়ে তোলেন উত্তর-বঙ্গের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সেন্ট যোসেফস হাই স্কুল (বর্তমানে সেন্ট যোসেফস হাইস্কুল এ্যান্ড কলেজ)। বনপাড়া মিশনে পালকীয় কাজ ও স্কুল পরিচালনার পাশাপাশি- জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে ফাদারের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক কিংবদন্তী হয়ে আছে।
ফাদার আঞ্জেলো মাজ্জীওনীর পালকীয় কাজের শেষ কর্মস্থল ছিল ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত বর্তমান রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের আন্ধারকোটা ধর্মপল্লীতে। এই বিশাল আদিবাসী ধর্মপল্লীর (বর্তমানে আন্ধারকোটা ধর্মপল্লী থেকে তৈরি হয়েছে সুরশুনিপাড়া, মহিপাড়া, নবাই বটতলা ও রাজশাহী ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লী। পরে ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লী থেকে তৈরি হয়েছে কলিমনগর ও মুশরইল ধর্মপল্লী), দূর-দূরান্তের প্রতিটি গ্রামেই সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি চমৎকারভাবে বাংলা এবং সান্তালি ভাষা বলতে পারতেন।
ফাদার আঞ্জেলো মাজ্জীওনী ছিলেন একজন প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি- যার মধ্যে প্রার্থনার জীবন ছিলো সুদৃঢ়। বিষয়-সম্পক্তি, অর্থ-কড়ি তাঁর কাছে ছিল অর্থহীন। তবুও এই অর্থের লোভে একদল ডাকাত তার নিজ বাসভবনে হামলা চালায়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ১৩ আগস্ট মধ্যরাতের পর, রাত একটার সময় (১৪ আগস্ট) ডাকাতদের গুলির আঘাতে ফাদার নিহত হোন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর যার মধ্যে ২৫ বছরই ছিল বাংলাদেশে তাঁর পালকীয় জীবন। শহীদ ফাদার আঞ্জেলো মাজ্জীওনী পিমের, ৫০তম মৃত্যুদিবসে তাঁর আত্মার কল্যাণ কামনা করি। তাঁর অবদান ও আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে তিনি আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।