ড. ফাদার শংকর ডমিনিক গমেজ
অধ্যক্ষ
সেন্ট যোসেফস্ স্কুল এন্ড কলেজ, বনপাড়া

একুশ শতকে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সাফল্য নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে (বোস, ২০১০)। দক্ষ নেতৃত্বদানকারী প্রধান শিক্ষকদের পরিচালনায় ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ঘটে এবং তারা শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের শিক্ষাদান করে সফলতা আনে।

শিক্ষাক্ষেত্রে নেতৃত্ব দান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুষ্ঠু নেতৃত্ব ও পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ঘটে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়। দক্ষ নেতৃত্বের দ্বারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি অনন্য ও নামকরা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে পারে। যিনি প্রধান শিক্ষক বা প্রশাসক থাকেন, তাঁর নেতৃত্বের উপরই বেশীরভাগ সাফল্য নির্ভর করে। কারণ তিনি কি ধরণের নেতা এবং কি ধরণের নেতৃত্বের কৌশল তিনি প্রয়োগ করেন । সুতরাং নেতৃত্ব কি? কেইথ ডেভিস এর মতে, নেতৃত্ব হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যা উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অনুসারীদের উৎসাহিত হতে সাহায্য করে। তাছাড়া পি. ডুকার বলেন, নেতৃত্ব মানুষের মন-মানসিকতা প্রস্থস্ত করে, মনোযোগ গভীর করে, তার কাজকে উচ্চতর মানে পৌঁছে দেয়, মানুষের স্বাভাবিক ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে তার ব্যক্তিত্ব গঠণ করে দেয়। অতএব, দক্ষ নেতৃত্বের দ্বারাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে, একাডেমিক মানোন্নয়ন হয় এবং সার্বিক দিকে দিয়েই উন্নতি হয়।

বর্তমানে সকল রাষ্ট্রপ্রধানগণ বিশ্বাস করেন, জনগণই দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। উনারা মনে করেন যে, জনগনকে শিক্ষা দিয়ে দক্ষ ও যোগ্য করে তুললেই তারা সম্পদে পরিনত হবে। এজন্য শিক্ষার মানোন্নয়নের উপর বেশী গুরুত্বারোপ করেন। তাই প্রধান শিক্ষকসহ প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলেন। প্রধান শিক্ষকগণ প্রতিদিনই সচেতনভাবে দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব দান করেন যেন শিক্ষার্থীরা দক্ষ জনশক্তি ও সম্পদে পরিণত হতে পারে। লেইথউড (১৯৯৯) এর মতে, প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ প্রতিদিনই সচেতনভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দান করেন।

লেইথউড (১৯৯৪) মনে করেন যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানগণই রূপান্তরকারী নেতা। কারণ, রূপান্তরকারী প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিশন, ভিশন ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তৈরী করেন এবং এই মিশন, ভিশন ও লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করে থাকেন। তিনি তার জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সহায়তা দিয়ে থাকেন। তার সুদক্ষ পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয় এবং শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আর্দশ নিরাপদ জোন বা অঞ্চল। শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে এসে নিরাপদে এবং নিশ্চিতে পড়াশুনা করতে পারে। তাদের মনে কোন ভয় থাকে না বরং আনন্দ ভরা মনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ভাবনায় সময়টুকু অতিবাহিত করে। একজন আদর্শ ও সাহসী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান তিনি তার প্রতিষ্ঠানে সবাইকে নিরাপত্তা দেন এবং নিরাপত্তা দেবার জন্য ঝুঁকি গ্রহণ করেন। যে ঝুকি নিতে পারেন, তিনি তার নেতৃত্ব দিয়ে সব কিছু সঠিকভাবে পরিচালনা করেন।

প্রতিষ্ঠান প্রধান তার নেতৃত্ব দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক ও পারস্পরিক বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সংস্কৃতি বা কালচার সৃষ্টি করেন। যখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে শ্রদ্ধাপূর্ণ সুসম্পর্ক থাকে, তখন শিক্ষা কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালিত হয় এতে সবাই সুন্দরভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকে। যার ফলস্বরূপ, শিক্ষার মান্নোনয়ন হয় এবং প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরীক্ষাসহ পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বা রেজাল্ট ভাল হয়। তাছাড়া সহশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বয়ে আনে।

শুধুমাত্র শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথেই যোগাযোগ রাখে না, বরং সরকারী শিক্ষা অফিস, শিক্ষাবোর্ডসহ আশে-পাশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ রাখে এবং একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলে যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্বের বড় গুণ হলো যোগাযোগ করা এবং এই যোগাযোগ করার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের সাথে যারা জড়িত তাদের সঙ্গে ভাল সর্ম্পক গড়ে তোলে যেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম সুচারুভাবে চলে।

প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্বের মাধ্যমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সুন্দরভাবে চলে। বিশেষ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভা, সেমিনার, কর্মশালা বা প্রশিক্ষণের আয়োজন করে তা বাস্তবায়ন করে থাকেন প্রতিষ্ঠান প্রধান। এজন্য তাকে জানতে হয় ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্ব দেওয়ার কৌশল। যিনি নেতৃত্ব দিতে জানেন না, তাকে দায়িত্ব দিলে প্রতিষ্ঠানে সবকিছুর মধ্যে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং বহুবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। এমনকি শিক্ষার মান্নোনয়ন হয় না এবং পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের বড় গুণ হলো নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা এবং জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা মোকাবেলা করা। এজন্য প্রধান শিক্ষককে সাহসিকতার পরিচয় দিতে হয় এবং সম-সাময়িক ঘটনা সর্ম্পকে সচেতন থাকতে হয় যেন পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার আগেই তা সুন্দরভাবে সমাধান করা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের, পেশার ও শ্রেণীর লোক জড়িত থাকে। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে কাজ করতে হয়। এজন্য প্রধান শিক্ষককে হতে হয় দূরদর্শী এবং প্রজ্ঞাবান। তিনি তার দূরদর্শীতা ও প্রজ্ঞা দ্বারা উদ্ভুত পরিস্থিতি সাহসের সহিত মোকাবেলা করতে হয়। সুতরাং নেতৃত্ব জানা না থাকলে সমস্যা সমাধান করা বা উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা তখন কঠিন হয়ে যায়।

প্রধান শিক্ষক নেতৃত্বে দৃঢ় থাকলে তিনি সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে, সঠিক কাজে লাগিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান্নোনয়ন ও অন্যান্য সব কাজ সুন্দরভাবে করতে পারেন। সুতরাং বলা যায় যে, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম।

 

 

Please follow and like us: