রক্ষাকারিণী মাকে ভালবাসি, তাঁকে শ্রদ্ধা করি এবং অত্র এলাকার মানুষেরা এ মায়ের প্রতি বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের পাক্ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এ বিশ্বাস নিয়েই প্রতিবারের ন্যায় এবারও ১৬ই জানুয়ারি, ২০২৩ খ্রি: রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থ স্থানে ভাব-গাম্ভীর্য পরিবেশে তীর্থ উৎসব উদযাপন করা হয়। এই তীর্থ উৎসবকে কেন্দ্র করে গত ৭ই জানুয়ারি থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০:০০টা থেকে দুপুর ১:০০টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৪:৩০ মিনিট থেকে ৫:৩০ মিনিট পর্যন্ত নভেনা, পাপস্বীকার সংস্কারগ্রহণ ও খ্রিস্টযাগের মাধ্যমে খ্রিস্টভক্তগণ তাদের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, এ নভেনা অনুষ্ঠানে আশে-পাশের বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন দল এসে তাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

১৬ জানুয়ারি নির্ধারিত সময়ে পর্বীয় খ্রিস্টযাগের আগে অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র ক্রুশের পথ। ক্রুশের পথের পরপরই পবিত্র খ্রিস্টযাগের মধ্যদিয়ে তীর্থের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। সকাল ১০:০০ মিনিটে শোভাযাত্রা সহযোগে পবিত্র খ্রিস্টযাগ শুরু হয়। পবিত্র খ্রিস্টযাগে পৌরহিত্য করেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও। এছাড়াও ৩০জন যাজক, ৪০জন সিস্টার ও প্রায় ৯,০০০ খ্রিস্টভক্ত খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেন বলে জানিয়েছেন নবাই বটতলার পাল-পুরোহিত ফাদার মাইকেল কোড়াইয়া।

বিশপ মহোদয় তার উপদেশে বলেন, খ্রিস্টেতে প্রিয়জনেরা, আজ আমরা এই নবাই বটতলায় এ তীর্থ স্থানে এসেছি রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার মধ্যদিয়ে ঈশ্বরের আশির্বাদ ও কৃপা লাভ করতে। সেই সাথে আমরা যে মানত করেছি তা পূরণ করতে কিংবা কেউ কেউ এসেছি নতুনভাবে মানত করতে যেন রক্ষাকারিণী মা মারীয়া আমাদেরকে আশির্বাদ করেন। ‘আমরা জানি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর অলৌকিকভাবে রক্ষাকারিণী কুমারী মারীয়ার মধ্যস্থতায় পাক্ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নবাই বটতলার গ্রামবাসীগণ রক্ষা পেয়েছিলেন। সে দিনকে বা রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার সেই আর্শিবাদের কথা স্মরণ করেই এই তীর্থস্থান গড়ে উঠেছে। তিনি আরো বলেন, পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিস আমাদেরকে শান্তির পথে চলতে আহ্বান করেছেন। তিনি বলেন, প্রকৃত শান্তি আসে মিলনের মধ্য দিয়ে, সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এবং পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক বজায় রেখে একসঙ্গে পথ চলার মধ্য দিয়ে।

রক্ষাকারিণী মা মারীয়াও ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করতে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করেছেন এবং আমাদের আত্মার পরিত্রাণের জন্য মুক্তিদাতা প্রভু যিশু খ্রিস্টকে জন্ম দিয়েছেন। তাই, আমাদেরকেও মা মারীয়ার মতো ঈশ্বরের বাধ্য হয়ে চলতে হবে এবং তার কাছে অবিরাম প্রার্থনা করতে হবে; যেন তিনি আমাদেরকে সর্বদা তার আশির্বাদে ঘিরে রাখেন ও রক্ষা করেন।

নবাই বটতলায় তীর্থে অংশগ্রহণকারী একজন বিশ্বাসীভক্ত তার বিশ্বাসের অনুভূতি তুলে ধরেন ঠিক এভাবে, ‘‘আমার স্ত্রী এতটুকু অসুস্থ্য ছিল যে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম সে মারা যাবে। কিন্তু স্বর্গীয় মা মারীয়ার প্রতি অগাধ বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করার পর সে সুস্থ্য হয়ে উঠেছিল। সেই থেকে আমি বিশ্বাস করি যে, রক্ষাকারিণী মা মারীয়াই আমার স্ত্রীকে সুস্থ্য করে তুলেছেন’’

তীর্থে অংশগ্রহণকারী মিসেস সবিতা টুডু নবাই বটতলা রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস প্রকাশ করেন এভাবে, মা মারীয়াকে আমি আমার মা হিসেবে গ্রহণ করি, তিনি সর্বদাই আমার বিপদে-আপদে পাশে আছেন এবং রক্ষা করে চলেছেন। আমার বিবাহের ৬ বছর পরে ঈশ্বরের কাছ থেকে আমি যে সন্তান পেয়েছি তাও মায়ের আশির্বাদেই পেয়েছি বলেই আমি বিশ্বাস করি। কারণ, ৬ বছর যাবৎ যখন আমাদের কোন সন্তান হচ্ছিল না তখন রক্ষাকারিণী মায়ের কাছে এসে মানত করেছিলাম এবং আমি আমার সন্তানকে লাভ করি। আমি জানি ও বিশ্বাস করি যে, রক্ষাকারিণী মা মারীয়া সর্বদাই আমার সঙ্গে আছেন এবং আমার যে কোন প্রয়োজনে মা আমাকে সাহায্য করবেন, পথ দেখাবেন এবং আমাকে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবেন।

রাজশাহী কারিতাসের আঞ্চলিক (ভারপ্রাপ্ত) পরিচালক মিঃ ডেভিড হেম্ব্রম তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, এই মাটিতেই আমার জন্ম এবং আজ আমার সৌভাগ্য হয়েছে এখানে এসে মা মারীয়ার তীর্থ উৎসবে অংশগ্রহণ করতে। আজ মনে পড়ছে সেদিনের কথা, যেদিন পাক্ সেনারা নবাই বটতলা গির্জায় আক্রমণ করতে এসেছিল; আমি বয়সে ছোট হলেও সেদিন আমি আমাদের গ্রামের লোকদের সঙ্গে সমবেত হয়ে রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার কাছে প্রার্থনা করে পাক্ সেনাদের কাছ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম।

সবশেষে নবাই বটতলা ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার মাইকেল কোড়াইয়া সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, রক্ষা কারিণী মা মারীয়ার তীর্থ উৎসব উদযাপন করার আসল দিনটি হল ৮ নভেম্বর; কেননা, রক্ষাকারিণী মা মারীয়া অলৌকিকভাবে ৮ই নভেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে নবাই বটতলাবাসীকে পাক্ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। সেই দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের লক্ষ্যেই নবাই বটতলাতে এই রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থ উৎসবটি উদযাপন করা হয়। কিন্তু খ্রিস্টভক্তদের সুবিধার্থে এবং পারিপার্শ্বিকতার জন্য পরবর্তীতে ১৬ই জানুয়ারি এই তীর্থ উৎসবটি পালিত হয়ে আসছে। যারা তাদের বিশ্বাস দিয়ে নবাই বটতলার রক্ষা কারিণী মা মারীয়ার তীর্থের ইতিহাস রচনা করেছেন তাদের জীবন ও বিশ্বাসের জন্য আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধা জানাই এবং কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। সেই সাথে আজকের এই অনুষ্ঠানকে সার্থক ভাবে উদযাপন করার জন্য যারা বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছেন তাদেরকেও আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। বিশেষভাবে স্মরণ করি, পুণ্য উপাসনায় যারা গান গেয়েছেন তাদেরকে এবং সেই সঙ্গে প্যারিশ কাউন্সিল, এস.ভি.পি দল, মারীয়া সংঘ এবং ওয়াই.সি.এস দলের সকল সদস্য-সদস্যাকে। সেই সাথে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরকে ও চেয়ারম্যান মোঃ বেলাল উদ্দিন সোহেলকে। আজকের এই খ্রিস্টযাগে যারা উদ্দেশ্য দান দিয়েছেন, পর্বকর্তা হয়েছেন এবং মানত রেখেছেন তাদেরকেও জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা; প্রার্থনা করি, যেন রক্ষাকারিণী মা মারীয়া আপনাদের সকলের মানত পূর্ণ করেন।

পবিত্র খ্রিস্টযাগের শেষ আশির্বাদের পর অনেক খ্রিস্টভক্তবিশ্বাসীগণ মা মারীয়ার গ্রটোর কাছে গিয়ে মায়ের আশির্বাদ গ্রহণ করেন এবং নিজ নিজ মানত অর্পণ করে রক্ষা কারিণী মা মারীয়ার তীর্থ স্থান থেকে বিদায় নেন।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার

 

Please follow and like us: