গত ১৫-১৬ মার্চ ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের আয়োজনে সান্তালসমাজ ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে মাঞ্জহি ও বাইসীর কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও, এসটিডি,ডিডি, উক্ত কর্মশালার আহ্বায়ক কারিতাস বাংলাদেশ রাজশাহী’র আঞ্চলিক পরিচালক (ডেজিগনেট) মি: ডেভিড হেম্ব্রম, ভিকার জেনারেল ফাদার ফাবিয়ান মারান্ডী, কর্মশালার উপদেষ্টা ফাদার উইলিয়াম মুরমু, খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রের পরিচালক ফাদার বাবলু কর্ণেলিউস কোড়াইয়া, ফাদার বিশ্বনাথ মারান্ডী, ফাদার বার্ণাড টুডু, ফাদার লুইস সুশীল পেরেরা এবং ফাদার হারুণ হেম্ব্রমসহ বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে আগত মোট ১৩৬ জন খ্রিস্টভক্ত এ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার শুরুতে বিশপ মহোদয় এবং বিভিন্ন ধর্মপল্লী হতে আগত সর্বমোট ৭ জন মোমবাতি প্রজ্বলন করেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল জের্ভাস রোজারিও তাঁর বক্তব্যে বলেন, একসময়কার স্বচ্ছল সান্তাল আদিবাসী এখন গরীব হয়েছে, তারা জমি, ভিটা ও সম্পদ হারাচ্ছে। ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং বণ্ডিং শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে একসময় ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হবে। সান্তালরা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলে না। ফলে ভাষা হারাচ্ছে। সান্তাল পরিবারে নিজ মাতৃভাষা ব্যবহার করা এখন সময়ে দাবী। শুধু তাই নয়, আমাদের সান্তাল সমাজে সান্তালী ভাষায় পড়াশোনা করা একান্ত আবশ্যক। তা না হলে ভবিষ্যতে সান্তাল সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সেই সাথে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সান্তাল সমাজকে আরো সচেতনভাবে ভ‚মিকা রাখতে হবে। সান্তাল সমাজে অন্যান্যদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য জোর তৎপরতা চালাতে হবে।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ফাদার ফাবিয়ান মারান্ডী তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, আজকের এই কর্মশালায় আমি আপনাদের সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা অভিনন্দন জানাই। সেই সাথে মাঞ্জহি ও বাইসী সদস্য হিসেবে যারা এসেছেন তাদেরকে আহ্বান জানাই, যেন তারা সমাজ পরিচালনায় আরো বেশী সক্রিয় হতে পারেন। কোন সংস্কৃতি অপরিবর্তনীয় নয় বরং সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। সমাজ, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের বিষয়ে যেন কোন সাংঘর্ষিক অবস্থার মুখোমুখি না হয় তার উপায় বের করা এবং সেই সাথে কৃষ্টি সংস্কৃতির চর্চা করার ব্যাপারে আরো বেশী যত্নশীল হওয়া দরকার।
সান্তালসমাজ ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে মাঞ্জহি ও বাইসীর কর্মশালার উপদেষ্টা ফাদার উইলিয়াম মুরমু তার বক্তব্যে বলেন, বহু দিনের প্রচেষ্টার পর এই মাঞ্জহি কর্মশালার আয়োজন করতে পেরেছি বলে আজ আমি সত্যিই আনন্দিত। এ কর্মশালা বাস্তবায়ন করার জন্যে বিভিন্ন পরিসরে ব্যাপকভাবে আলোচনা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের এই ডিজিটাল যুগে অনেক কিছুরই পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া আমাদের সমাজে, আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের সান্তাল সমাজের জন্যও যা কিছু পরিবর্তন যোগ্য তার পরিবর্তন এনে সমাজের কল্যাণ হয়, এমন সিদ্ধান্ত এই সভায় গ্রহণ করাই আমাদের এই কর্মশালার মূল লক্ষ্য।
সান্তাল সমাজের সামাজিক কাঠামো বিষয়ের উপর আলোচনা করতে গিয়ে মি. বেনজামিন টুডু, গবেষণা কর্মকর্তা, বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, রাজশাহী বলেন, সবার আগে আমাদের জানতে হবে সান্তাল সমাজ কি এবং এর ইতি কথা। সান্তাল সমাজের সমাজ কাঠামোতে আছে (মাঞ্জহি, পারানিক, জগমাঞ্জহি, জগপারানিক, নাইকী, কুডাম নাইকী, গডেত)। পারগানা ও বাইসী কাঠামোতে আছে পারগানা, সেক্রেটারি, দেশ মাঞ্জহি এবং চাকলাদার এবং সেই সাথে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে খ্রিস্টান সমাজের জন্য প্রস্তাবিত মাঞ্জহি বাইসী কাঠামোতে থাকবে ১) মাঞ্জহি ২) জগমাঞ্জহি ৩) নাইকী ( যাজক/প্রার্থনা পরিচালক) ৪) গডেত ৫) নারী সদস্য ৬) নারী সদস্য।
মাতৃভাষা শিক্ষা গ্রহণে সান্তালী বর্ণমালার ব্যবহার সম্পর্কে রাজশাহী কলেজের সহকারী অধ্যাপক মিঃ সামসন হাঁসদা তার উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশে সান্তালদের জন্য সান্তালী বর্ণমালা ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা বিষয়ে কথা বলেন এবং সেই সাথে এই সান্তালী বর্ণমালা রক্ষার জন্য আগামীতে কি করণীয় সেই বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেন।
মুন্ডুমালা ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত শ্রদ্ধেয় ফাদার বার্ণাড টুডু সান্তাল সমাজের উৎসবাদি ও পর্ব সম্বন্ধে তার উপস্থাপনায় বলেন, সান্তালদের মৃতদের সৎকার কিভাবে করা হয়, সহরায়পরব, বাহাপরব, লবান ও এরকপরব বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে খ্রিস্টীয়করণের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
সান্তাল সমাজের একজন বিশিষ্ট গবেষক মিঃ গাব্রিয়েল হাঁসদা, সান্তাল সমাজের সংস্কৃতিতে আচার অনুষ্ঠান এর তথ্য, তাত্বিক, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় দিকে করণীয় বিষয়গুলো সুচারুভাবে তুলে ধরেন।
কর্মশালার আহবায়ক মি. ডেভিড হেম্ব্রম বক্তব্যে বলেন- মাইগ্রেশনের কারণে আমাদের আচার-আচরণ, প্রথার কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। রীতি-নীতি, আইন-কানুন পালন সবগুলোই জরুরী। তারপরও প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে একান্ত প্রয়োজনীয় যা সমাজ, পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারার মত যেন আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। সেই সাথে কৃষ্টি সংস্কৃতি চর্চা ও রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাই, এই ব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন হতে এবং কৃষ্টি সংস্কৃতির রক্ষার ব্যাপারে আরো যত্নশীল হতে হবে। তাই, আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে এবং এই অঙ্গীকার নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে “আমরা সান্তাল আমাদের বর্ণমালাও হতে হবে সান্তালী।”
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : সুশীল বি টুডু