ভূমিকা : “পুনরুত্থানের পর যিশুর প্রথম কথাটি কি ছিলো?” যদি আমি এই প্রশ্ন করি, তাহলে প্রায় সকলেই উত্তর দিবে, “তোমাদের শান্তি হোক”। কিন্তু আসলেই কি তাই? বাইবেলে কিন্তু সেই রকমটি নয়- বাইবেলে পুনরুত্থানের পর যিশুর প্রথম কথাটি ছিলো: “মা!” (“নারী” যোহন ২০:১৫)। কিন্তু পুরোহিত বা যাজকগণ উপদেশ দিবার সময় খুব কমই এই বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলেন। পুনরুত্থানের পর যিশুর প্রথম সাক্ষাৎ হয় একজন নারীর সঙ্গে- ‘মারীয় মাগ্দালেনার সঙ্গে’ (মার্ক ১৬:৯)। যিশুর প্রথম কথা ছিল, “মা, তুমি কাঁদছো কেনো?” (যোহন ২০:১৫)। অবাক করার বিষয় হলো যে, যিশু যাকে প্রথম মিশনারি হিসেবে প্রেরণ করেছেন, সে ছিল একজন “নারী” (মার্ক ১৬:১০)।
ঈশ্বর নিজেই ‘মানুষ’ সৃষ্টি করেছেন। তাদের তিনি সৃষ্টি করেছেন পুরুষ ও নারী করে- ঈশ্বর তাঁর নিজের প্রতিমূর্তিতেই তিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন (আদি ১:২৬-২৭)। মাটি থেকে পুরুষকে (মানুষ) সৃষ্টি ক’রে তার নাকে ফুঁ দিয়ে তিনি তাকে জীবন দান করেন (আদি ২:৭)। ঈশ্বর মানুষ অর্থাৎ পুরুষকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করেন, তার মধ্য থেকে অর্থাৎ তার পাঁজর থেকে নেওয়া একটি হাড় দিয়ে একজন নারীকে সৃষ্টি করতে পারেন। এতে মানুষের কোনো ভূমিকা ছিল না। নারীকে ঈশ্বর নিজেই তাঁর নিজের ইচ্ছায় ও সৃজনশীলতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন (আদি ২:২১-২২)। নারীদের ঈশ্বর শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে তৈরি করেছেন- তবে অনেক বিষয়েই সে দুর্বল ও ভঙ্গুর। সেই জন্য পুরুষদের জন্য সে অর্ধাঙ্গিনী, আর তার সঙ্গে পুরুষদের সদ্ব্যবহার করা আবশ্যক। তাকে কষ্ট দিলে বা ধ্বংস করতে চাইলে, পুরুষ নিজেকেই আহত করবেন; নিজের হৃদয় মনকেই সে নিঃশেষ করে ফেলবেন।
আদি থেকেই মানব জাতির মধ্যে নারী ও পুরুষ রয়েছে; আর মানব জাতির অস্তিত্ব নিহিত রয়েছে পুরুষ-নারীর সম্পর্কের মধ্যে। তাই পুরুষই হোক বা নারীই হোক কেউ পূর্ণাঙ্গ নয়- তার পূর্ণতা আসে নারী-পুরুষের মিলনে। একজন অন্যজনকে ছাড়া পূর্ণ নয়। এটা শুধু যে লিঙ্গের পরিপূরকতা (Complementarity) তা নয়, বরং পারস্পরিকতা বা পারস্পরিক সম্বন্ধও (Reciprocity)। এই পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াই মানব লিঙ্গকে মানবীয় (Humanize) করে তোলে। পুরুষ যা করতে পারে, নারী তা করতে পারে কিনা বা নারীর কাজ পুরুষ করতে পারে কিনা সেটা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হতে পারে। আসল সত্য হলো যে, তাদের উভয়কেই পারস্পরিকতা ও একে অন্যকে সমর্থন দিয়ে এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন তারা পরস্পরকে সম্পূর্ণতা (Complete) দান করতে পারেন ও পরস্পরের পরিপূরক (Complement) হতে পারেন। আমরা পুরুষ-নারীরা তখনই বেশি মানবীয় হতে পারি যখন আমরা পরস্পরকে সমর্থন ক’রে একে অন্যকে শক্তিশালী করে তুলতে পারি; নারীর যথোপযুক্ত ক্ষমতায়ন (Empowerment) না হলে তা সম্ভব নয়। এক পাখায় তো আর পাখি উড়তে পারে না।
অন্তর্ভূক্তিমূলক : ঈশ্বরের ভাষা অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সর্বপরিবেষ্টিত; তাই নারী ও পুরুষ তাঁর কাছে কোনো পৃথক কিছু নয়, তাঁর কাছে পুরুষও যা নারীও তা- উভয়েই সমান মর্যাদা ও অধিকারসম্পন্ন। এটাই বাইবেলের শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা। আদিম সমাজে নারীকে ভাবা হতো দুর্বল লিঙ্গ (Weak sex); পরবর্তীতে তাদের মনে করা হতো বিপরীত লিঙ্গ (Opposite sex); তারপর তাদের মনে করা হয়েছে পরিপূরক লিঙ্গ (Complementary sex)। আজ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে, এমন কি অনেক উন্নয়নশীল দেশে নারীকে ভাবা হয় পুরুষের সমান। এটা সম্ভব হয়েছে এই পারস্পরিকতার (Reciprocity) জন্যই।
পরস্পরকে আমাদের প্রয়োজন আছে। আমরা একা বাঁচতে পারি না- অন্যের সমর্থন ও সহায়তা আমাদের একান্তই প্রয়োজন। শুধু পুরুষের সমাজ বা নারীর সমাজ আমরা কল্পনাও করতে পারি না। নারী-পুরুষের যেটুকু পার্থক্য সেটি তাদের দৈহিক গঠনে, মননে ও আবেগ-অনুভূতিতে; কিন্তু মানব জীবনের মর্যাদা ও অধিকারে উভয়েই সমান। আমাদের সৃষ্টি করেছেন একই ঈশ্বর এবং এক সমান করে।
লিঙ্গ সমতা ঈশ্বরের পরিকল্পনা : পুরুষ ও নারীকে সমান মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে সৃষ্টি ক’রে এই ব্যাপারে ঈশ্বর তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। ঈশ্বর যা করেছেন তা আমাদের প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝতে হবে, শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়। ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন একটি মানবীয় সমাজ, কোনো পিতৃতান্ত্রিক সমাজ (Patriarchal) বা মাতৃতান্ত্রিক (Matriarchal) সমাজ নয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বাদ দিয়ে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ স্থাপন করলে আমাদের সমাজের ত্রুটি বিচ্যুতি দূর হবে এমন আশা করা যায় না। ঈশ্বর চান যেন আমাদের মানব-সমাজ সত্যিকারেই মানবীয় হয়ে উঠে। আমরা যেন গ্রীক দর্শনের দ্বিত্ববাদ (Dualism) দ্বারা প্রভাবিত না হই। আমরা যেমন কেউ একই সময় দুই স্বভাবে থাকতে পারি না, তেমনি কোন কিছুই একই সঙ্গে দুই রকম হতে পারে না।
নারীবাদ কোনো নারী বিষয়ক ভাবনা নয়। এটা মানবিকতার বিষয়, নৈতিক বিষয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়। এর মধ্যে ঈশ্বর নিজেই প্রকাশিত হন- তিনি তো পুরুষ ও নারী উভয়ই। ঈশ্বর আমাদের পিতা ও মাতা উভয়ই। নারীর ক্ষমতায়ন (Empowerment) মানে সংকীর্ণ অর্থে শুধু ‘নারীবাদ’, ‘নারী-মুক্তি’ ‘নারী আন্দোলন’ বা ‘নারী অধিকার’ বুঝায় না। নারীকে ক্ষমতায়ন করা মানে হলো তাকে পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া- তাকে কোনো অগ্রাধিকার দান করা নয়। দৈহিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ইত্যাদি কারণে পুরুষ ও নারীর কিছু আলাদা ভূমিকা আছে যা আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। পুরুষ যেমন মা হতে পারে না, তেমনি নারীও কখনও বাবা হতে পারে না। তবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণে সমাজ পুুরুষকে বা নারীকে কিছু কাজ ও ভূমিকা নির্ধারণ করে দিয়েছে- যা নিতান্তই মনুষ্য সৃষ্ট। সেই মনুষ্য সৃষ্ট নিয়ম বদল করা যায়। বলা হয়ে থাকে পুরষ জমি চাষ-বাস করবে, চাকুরী করবে, অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করবে, ইত্যাদি; আর নারী ঘর-দোর ও সন্তানদের যত্ন করবে, রান্না করবে, কাপড় কাচবে, ইত্যাদি। বর্তমানে এই আধুনিক যুগে দেখা যাচ্ছে নারী ট্রাক্টর চালিয়ে চাষাবাদ করেন, গাড়ি চালান, বিমান চালান, চাকুরী করেন, এমন সব কাজ করেন যা চিরাচরিতভাবে মনে করা হতো এগুলি পুরুষের কাজ। তাহলে মেয়েদের আর ঘুমটা দিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখা কেন? “নারী অগ্রে” (Woman first) যখন বলা হয়, তখন কিন্তু তার মর্যাদা বা অধিকার বেশি সেই কথা বুঝানো হয় না, বরং তার দৈহিক ও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই তাকে নির্বিঘ্নে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ ক’রে দেওয়া হয়।
নারীরা যখন নারী অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে- তা পুরুষদের বিরুদ্ধে নয়, সেই আন্দোলন হয় সামাজিক কাঠামো ও কুপমুন্ডুকতার বিরুদ্ধে। নারীদের ক্ষমতায়ন করা না হলে, পুরুষরাও চিরকাল ক্ষমতার বাইরে পড়ে থাকবে। সামাজিক কুসংস্কারের কারণে বৈষম্যমূলকভাবে নারীকে ক্ষমতা বঞ্চিত ক’রে রাখা মানেই হলো সমাজকে পিছনের দিকে নিয়ে যাওয়া। নারী ও পুরুষ একসঙ্গে কাজ ক’রে একটি “নতুন সমাজ” তৈরি করতে পারে- যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না, বরং মর্যাদা ও অধিকারে তারা হয়ে উঠবে সমান ও পরিপূরক। প্রত্যেক ব্যক্তিই সে নারী বা পুরুষ যা-ই হোক, ঈশ্বরের কাছ থেকে বিশেষ গুণাবলি ও প্রতিভা পেয়েছেন। প্রত্যেক ব্যক্তিরই আহ্বান হলো সেই প্রতিভা ও গুণাবলি বাড়িয়ে তোলা ও সে অনুসারে জীবন যাপন করা। এইভাবে একটি উন্নত “নতুন পৃথিবী” গড়ে উঠবে।
ভারতীয় নারী ধর্মব্রতিনীদের সম্মিলনী (Conference of Women Religious of India) ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে যেমনটি বলেছিল “আমাদের মনোভাবের আমূল পরবর্তন হতে হবে: অন্তর্মুখী নারী, জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা অবস্থা থেকে নারীকে হতে হবে বিশ্ব দর্শনের এক নারী যার মিশন হলো প্রাবক্তিক। এক পরাধীন মায়ের পিছনে পড়ে থাকা কন্যা থেকে তাকে হতে হবে ঈশ্বরের প্রেমপূর্ণ এক কন্যা; সে হবে এই পৃথিবীর একজন এবং এই পৃথিবীরই জন্য।”
পুরুষের যেমন শারীরিক শক্তি বা ক্ষমতা আছে, তেমনি নারীকে ঈশ্বর দিয়েছেন অন্তরের মনোবল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো পুরুষরা এখনও নারীদের পিছনে ফেলে রাখতে, তাদের দাস করে রাখতে আনন্দ পায়। অন্যদিকে পরিতাপের বিষয় হলো যে, এখনও নারীরা নানা কারণে নিজেদের পুরুষদের দাসী করে রাখতে চায়। তাই বলা যায়, পুরুষ-নারীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের যে অপরাধ হয়ে আসছে তার জন্য পুরুষরা যেমন, নারীরাও তেমনই দায়ী। এই অপরাধ শুধু নারীদের বিরুদ্ধে নয়, এই অপরাধ মানবতার বিরুদ্ধে। যিশু পুরুষদের মত নারীদেরও পরিত্রাণ দিয়েছেন ও সমানভাবে সকলকেই ক্ষমতায়ন করেছেন, নারীদেরও তা করেছেন। নারীরাও যিশুর মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন- পুরুষদের পাশাপাশি সমানতালে। যিশু তাঁর জীবদ্দশায় নারীদের সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা বলেন নি। যিশুর পুরুষ শিষ্যদের মতই তাঁর নারী শিষ্যরাও তাঁর প্রকাশ্য জীবন ও প্রচার কার্যে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু যিশুর যন্ত্রণাভোগ ও ক্রুশমৃত্যুর সময় তাঁর পুরুষ শিষ্যরা যখন পালিয়ে গিয়েছিলেন, তখন যিশুর নারী শিষ্যরা তাঁকে ছেড়ে যান নি। মা মারিয়ার সঙ্গে যিশুর নারী শিষ্যরা ক্রুশের তলায় দাঁড়িয়ে যিশুর কষ্টের সহভাগী হয়েছেন।
প্রথম খ্রিস্ট-মণ্ডলিতে নারী : প্রথম খ্রিস্টমণ্ডলিতে নারী খ্রিস্টবিশ্বাসীরা অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে অনেক সাহসী ভুমিকা পালন করেছেন এবং খ্রিস্টবিশ্বাসের সাক্ষ্য দান করেছেন। খ্রিস্টবিশ্বাস ইহুদি নারীদের আকর্ষণ করেছিল কারণ এখানে ইহুদী সমাজের কুসংস্কার, বিচার করার মনোভাব ও ভন্ডামী ছিল না। এই সব সামাজিক দুষ্টক্ষত থেকে মুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে যিশুর বাণী প্রচার করতে পারতেন। খ্রিস্টবিশ্বাস তাদের সামাজিক কুসংস্কার ও বৈষম্য থেকে মুক্ত স্বাধীন করেছিল। সাধু পল যেমন বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে এখন ইহুদীও নেই, অনিহুদীও নেই; ক্রীতদাসও নেই, স্বাধীন মানুষও নেই; পুরুষও নেই, নারীও নেই; কারণ খ্রিস্টযিশুর সঙ্গে মিলিত হয়ে এখন তোমরা সকলেই এক হয়ে আছ” (গালা ৩:২৮)। নীচু শ্রেণি বা অধিনস্ত পদ বা কাজ মানুষেরই তৈরি- ঈশ্বরের নয়। উচু নীচু শ্রেণি থাকলে সমাজের কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়। খ্রিস্টযিশু তাই এইসব মন্দ রীতি ও ক্ষতিকর কৃষ্টি বাতিল করে দিয়েছেন। রোমীয় আইনে দাস ও স্বাধীন মানুষ; শাসক ও শাসিতের মধ্যে একটি স্পষ্ট ভেদরেখা দিয়ে দিয়েছে। এমন কি মন্দিরেও একজন ইহুদী ও একজন অনিহুদী বিদেশির মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য করা হতো। গ্রীকদের মনে করা হতো ইহুদীদের চেয়ে নীচু জাত। সমাজে মানুষের অন্তর-গভীরে ছেলে সন্তান ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে কৃষ্টিগতভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করার কুসংস্কার রয়েছে। এক সময় সারা বিশ্বেই পুরুষদের আধিপত্য প্রকট ছিল- এখনও নারীরা শুধুমাত্র কুসংস্কারের কারণে অহরহই বৈষম্যের শিকার হয়। কোনো কোনো দেশে ও স্থানে এই বৈষম্য হুমকী ও নির্যাতনমূলক। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সমাজ, ধর্ম, শাসন ব্যবস্থা সবই ধর্মান্ধতা বা গোড়ামী, পুরুষ প্রাধান্য, অন্ধ জাতীয়তাবাদ, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা, অন্যাযতা, ইত্যাদি দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। তার প্রভাব এখনও যথেষ্ঠ প্রবল।
কিন্তু সাধু পলের মতে খ্রিস্ট আসার ফলে এই সব কিছু বাতিল হয়ে গেছে। তাই সমাজে বা সংস্কৃতিতে কৃষ্টি বা রীতি-নীতি যা-ই থাকুক না কেন মণ্ডলির আইনে এই সব কিছুই পরিবর্তিত হয়ে নতুন হয়ে গেছে। পুরুষ ও নারী শুধু মাত্র ‘সমান’ই নয়, তারা পরিপূরক হয়ে ‘এক’ হয়ে গেছে। প্রেরিতদের কার্যাবলীতে আমরা দেখি যে, আদি মণ্ডলিতে মহিলারা বা নারীর উপাসনায় ডিকন বা পরিসেবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। রোমীয়দের কাছে পত্রে সাধু পল তাঁর ভাল বন্ধু ও ধর্ম বোন ফৈবীর কথা উল্লেখ করেছেন যিনি ডিকন ছিলেন (রোমীয় ১৬:১-২); বাইবেলের মধ্যে শুধু তিনিই ছিলেনএকমাত্র ডিকন। পলের ভাষায় ফৈবী শুধু ডিকনই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আদি মণ্ডলির একজন নেত্রী ও সাহায্যকারিনী। তাঁর ক্ষেত্রে লিঙ্গ, বয়স, জাত, বর্ণ-গোত্র, দৈহিক ক্ষমতা, বৈশিষ্ট্য, ইত্যাদি কোন পার্থক্যই মানা হয়নি।
পোপ ফ্রান্সিস ও সিনোডাল মণ্ডলি : পোপ ফ্রান্সিসের ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর পোপীয় পালকীয় শাসনামলে “সিনোডাল” বা মিলনধর্মী কথাটির মত আর কোনো কথা এত আলোড়ন তুলতে পারে নি। এটাই খ্রিস্ট- মণ্ডলি সম্পর্কে তাঁর ‘ভিশন’ বা ‘দর্শন’। মণ্ডলি যে বিশ্বাসী ভক্ত সকলের আর সকলে মিলেই যে মণ্ডলি তিনি তা বার বার সবার কাছে বলে চলেছেন। তার মতে মণ্ডলি সকল খ্রিস্ট-বিশ্বাসী মিলে, যাজক, খ্রিস্টভক্ত পুরুষ ও নারী, সকলের মণ্ডলি। এই মণ্ডলিতে সকলেই সমান- কেউ বড় ছোট বা উচু নীচু নয়। যারা যাজক শ্রেণির বিভিন্ন পদে রয়েছেন তাঁরাও কোনো ব্যতিক্রম নয়; তাঁদের উচিত মণ্ডলির খ্রিস্ট-বিশ্বাসী নারী পুরুষ, দরিদ্র ও ধনী, সমাজের বাইরে পড়ে আছে, তাদের সকলের কথা শোনা ও তাদের কথা বলতে দেওয়া।
পোপ ফ্রান্সিস ২০২১ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ইরাক সফর শেষে রোমে ফেরার সময় বিমানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন: “আজ নারী দিবস, জগতের সকল নারীদের প্রতি আমার অভিনন্দন! ইরাকের প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ‘কোন পুরুষ দিবস’ নেই কেন এই প্রশ্ন উঠেছিল। উত্তরে পোপ বলেছিলেন ‘কারণ আমরা পুরুষরা সারা বছরই সেই দিনটি উদযাপন করি!”
আমরা সকলের কথা শুনতে আহুত এবং আমরা পরস্পরের কথা শুনলে সব সময়ই কিছু না কিছু শিখতে পারি, কারণ আমরা কেউ সবজান্তা নই। কিন্তু সব মানুষই এমন কিছু জানে যা অন্যরা জানে না। তাই আমরা কেমন মনোযোগের সঙ্গে অন্যদের কথা শুনি তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা আমাদের মত নয় বা যারা আমাদের চেয়ে ভিন্নভাবে কথা বলেন- তাদের কথা শোনা সহজ নয়। আমরা কি একগুঁয়ে ও অনড়? নাকি আমরা সম্প্রীতি, সহনশীলতা ও সংলাপের পথে চলি? যদি আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা সকলেই ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট, তাহলে অন্যদের কন্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ, বড় বা ছোট, সবল বা দুর্বল, প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক, যা-ই হোক না কেনো- আমরা শুনব। আমরা যদি সেই সব কন্ঠস্বর শুনতে না চাই বা তা শুনতে অস্বীকৃতি জানাই তাহলে পক্ষান্তরে আমরা যিশুখ্রিস্টের দেহ মণ্ডলির কথা শুনতেই অস্বীকৃতি জানাই। সেটা আমাদের জন্য ক্ষতি ছাড়া লাভ বয়ে আনবে না।
‘কুরিয়া’ বা মাণ্ডলিক প্রশাসনিক দপ্তরে নারী : ‘সিনোডাল’ (Synodal) পদ্ধতি বা মিলনধর্মী মণ্ডলি যেন মণ্ডলি পরিচালনায় কোপেরনিকাসের পদ্ধতির পরিবর্তন। কোপেরনিকাস ছিলেন একজন ধর্মযাজক, যিনি সর্বপ্রথম বলেছেন যে সূর্য্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে না, বরং পৃথিবী সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরে। পোপ ফ্রান্সিস, ড: ফ্রান্সেস্কা জোয়ান্নি’কে পররাষ্ট্র বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি নিয়োগ করেছেন; ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ের একজন সদস্য সিস্টার রাফায়েলা পেত্রিনি’কে নিয়োগ দিয়েছেন ভাটিকান সরকারের মহাসচিব হিসেবে। এইসব পদে এর আগে কখনোই কোনো নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
ফ্রান্স দেশের জেভিয়ের সম্প্রদায়ের একজন সদস্যা সিস্টার নাথালি বেকার্ট’কে পোপ ফ্রান্সিস বিশপগণের সিনোডের একজন আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করেছেন- যিনি সেখানে ভোটও দিতে পারেন। এটা প্রমাণ করে যে, পোপ ফ্রান্সিস নারীদের কণ্ঠ শুনতে কতটা গুরুত্ব দেন। তাছাড়াও পোপ ফ্রান্সিস নিয়োগ দিয়েছেন সমন্বিত মানব উন্নয়ন বিষয়ক পোপীয় দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে সিস্টার আলেসান্দ্রা স্মেরিল্লি’কে। তিনি খ্রিস্টভক্তদের সহায় মারীয়ার কন্যা সংঘের একজন সদস্যা। এছাড়াও সিস্টার কার্মেন রস নর্তেস’কে নিয়োগ দিয়েছেন নিবেদিত জীবন সম্পর্কিত পোপীয় দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে।
২০২২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুলাই পোপ ফ্রান্সিস বিশপগণের কর্ম সংক্রান্ত দপ্তরে তিনজন মহিলা নিয়োগ দিয়েছেন- যাদের কাজের মধ্যে একটি হলো বিশপ কে হবেন তা নির্বাচন করা। তাদের মধ্যে দুইজন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের- সিস্টার রাফায়েলা পেত্রিনি এবং সিস্টার ইভন রয়েন্গুট, যিনি খ্রিস্টভক্তদের সহায় মারীয়ার কন্যা সংঘের প্রাক্তন সুপেরিওর জেনারেল, আর মারীয়া লিয়া যেরভিনো, যিনি একজন নিবেদিত জীবনের নারী এবং কাথলিক নারীদের বিশ্ব সংস্থার বর্তমান প্রেসিডেন্ট। তাঁরা আটজন কার্ডিনাল ও দুইজন আর্চবিশপের সঙ্গে মিলে বিশপগণের এই দপ্তরে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বিশপ নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। অবশ্য পোপ মহোদয় নিজেই স্বাধীনভাবে বিশপদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
এই সব নিয়োগসহ অন্যান্য নারীদের পোপীয় বিভিন্ন দপ্তরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিয়োগ দিয়ে পোপ ফ্রান্সিস এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তিনি নারীদের মতামতের উপর গুরুত্ব দিতে আগ্রহী এবং তা বাস্তবায়নে তাঁর আন্তরিকতা রয়েছে। এই পোপ আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, মণ্ডলিতে পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রয়োজন ও গুরুত্ব রয়েছে। একইভাবে সমাজে ও পরিবারে নারীদের একই গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে, যা থেকে তাদের বঞ্চিত রাখা উচিত নয়। সমাজে বা মণ্ডলিতে কাউকেই পিছনে ফেলে রাখা বা বাইরে রাখা উচত নয়। নারীদের ছাড়া পুরুষরা কোন ক্রমেই পরিপূর্ণতা ও সফলতা লাভ করতে পারবে না। তেমনিভাবে মণ্ডলিতেও নারীদের স্থান হতে হবে বাস্তব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, নীতি নির্ধারণী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে- শুধু নির্দেশ পালন করা ও তা বাস্তবায়ন করা পর্যায়ে নয়।
মার্চ ২৬, ২০২২ খ্রিস্টাব্দে নারী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সুপেরিওর জেনারেলদের এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে ভাষণ দেবার সময় সি. নাথালি বেকার্ট বলেছেন যে ‘সিনোডালিটি’ হলো ক্ষমতায়নের একটি পদ্ধতি, বিশেষভাবে নারীদের জন্য, যা মণ্ডলিকে একটি ‘নতুন দর্শন’ দান করবে। তিনি বলেন, সিনোডালিটি কোনো সহজ বিষয় নয়, এর জন্য আমাদের জীবন যাপনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে আমাদের যে চিরাচরিত ধারণা তার পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তনের পথে বাধা হতে পারে- আমাদের ভয়, উদ্বেগ, পরিবর্তনের অনিহা, ইত্যাদি। প্রভাব বিস্তার করা ও নিয়ন্ত্রণ করার অভ্যাস ও প্রবণতা এখনো আছে, কিন্তু এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, ঈশ্বরের সামনে আমরা সকলেই সমান নয়- আর সব কিছুর সমান অংশীদারি নয়। আমাদের সকলের কথাই শুনতে হবে- শুনতে হবে নারীদের, যুবক-যুবতীদের, বিভিন্ন নির্যাতনের শিকারদের, দরিদ্রদের এবং যারা পড়ে আছে সমাজের প্রান্তসীমায় বা বাইরে তাদের। নারীকে ছাড়া পুরুষ আর পুরুষকে ছাড়া নারীকে আমরা কিভাবে চিন্তা করতে পারি?
নারীদের দমিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা হলেও, ২য় ভাটিকান মহাসভার পর থেকে ধারাবাহিকভাবেই মণ্ডলিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে চলেছে। ধর্মব্রতী নারী ও খ্রিস্টভক্ত নারীদের মধ্যে অনেকেই এখন জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও মণ্ডলি পর্যায়ে বেশ অগ্রগণ্য। তারা নীতি নির্ধারণী ও নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। সিনোড সংক্রান্ত সিনোডের আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক কমিটির একজন সদস্যা সিস্টার প্যাট্রিশিয়া র্মুরে’র মতে নারীরা এখন বেশ এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, মানুষের বিপদে আপদে নারীরা সবার আগে এগিয়ে যায় ও সংবেদনশীল হয় কারণ তাদের মধ্যে এই গুণ সহজাত (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১)।
পোপ ফ্রান্সিস অনেকবারই বলেছেন যে, সিনোড কোনো পার্লামেন্ট নয়; এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠ বিষয় নয়; কোনো বিতর্কে হার-জিতের বিষয় নয়; এটা হবে পবিত্র আত্মার প্রেরণায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সিনোডের পদ্ধতি হলো একটি আধ্যাক্তিক পদ্ধতি। পবিত্র আত্মা যদি এর কেন্দ্র বিন্দুতে না থাকেন তাহলে সেখানে সিনোড হতে পারে না।
একজন বিখ্যাত পুরোহিত পিটার ডালি বলেছেন, বিশপ, যাজকগণ- অর্থাৎ যাজকতন্ত্র- সব সময় ভাবেন যে, আমাদের আলাদা ক’রে রাখা হয়েছে এবং মণ্ডলিতে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। তাদের আচরণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। তাদের জীবন যাপন নিয়েও কোনো কথা বলা যাবে না।
যাজকত্ববাদ (Clericalism) লতিয়ে উঠেছে : “যাজকত্ববাদ হলো যাজকত্বের বিকৃতি” পোপ ফ্রান্সিস এই কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন। ঈশ্বর আমাদের সকলকেই সমান করে সৃষ্টি করেছেন, কেউ কারো দাস হয়ে থাকবে সেই জন্য নয় বরং সমান স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করার জন্য। একজন পুরোহিত বা ধর্মব্রতী যদি মনে করেন যে তার কাজের জন্য বিশেষ পুরষ্কার পাওয়া উচিত বা তার জন্য সে যদি কোন বিশেষ আচরণ আশা করে; অথবা সে যদি অন্যদের তুলনায় নিজেকে বড় মনে করে, নিজেকে বেশি পবিত্র মনে করে, নিজেকে বিশেষ কিছু মনে করে, নিজেকে উচু শ্রেণির মনে করে, তাহলে সে একজন যাজকত্ববাদী। শুধু মাত্র যাজক বা পুরোহিতদেরই যে এই মনোভাব রয়েছে, তা নয়। যাজকত্ববাদী এই মনোভাব অন্যদেরও থাকতে পারে- সে নারী বা পুরুষ যা-ই হোক; বিশেষভাবে ধর্মব্রতী-ধর্মব্রতিনীদের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। আসল কথা হলো কেউ কোনো স্পেশাল বা বিশেষ কেউ নই। অনড় মনোভাব থেকেই যাজকত্ববাদের জন্ম হয়। গত ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২২ তারিখে সাধারণ সাক্ষাতের সময় পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, “কোনো সময় যদি কেউ যাজকত্ববাদের শিকার হয় তাহলে তা প্রতিরোধ করা উচিত, মাঝে মাঝে মণ্ডলিতেও কেউ কেউ এই ধরণের অন্যায্যতার শিকার হয়; তারা অনেক কঠিন পরিশ্রম ক’রে সেবা কাজ করলেও, তাদের দাস বানানো হয়। এমন কি তা মণ্ডলির পরিচালকদের ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা যায়।”
যারা যাজকত্ববাদের শিকার হয় তারা আসলে দুর্বল, অসহায় ও ক্ষমতাহীন; আর সেই জন্যই সমাজ ও মণ্ডলির কাঠামো তাদের কোন্ঠাসা ও অরক্ষিত (Vulnerable) করে রেখেছে। এই কারণেই শোষণ ও নির্যাতন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে আর সেই রকম ঘটনা প্রকাশ হওয়ার আগেই তা মুছে ফেলা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো- এরূপ ক্ষেত্রে যিশু কি করতেন? যিশু কি আশা করে বসে থাকতেন, যে অন্যায্যতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সে-ই এর মোকাবেলা করবে, নাকি তিনি নিজেই সমাজে ও মণ্ডলিতে অন্যায্যতা, শোষণ ও নির্যাতনের কাঠামো ভেঙ্গে ফেলতেন? যিশুর দয়া ও সংবেদনশীলতা এমনই যে তিনি ন্যায্যতা আনয়নের জন্য কারও জন্য অপেক্ষা করতেন না।
সমাজে বা মণ্ডলিতে নারীদের যে ক্ষমতা বা মর্যাদা হারিয়ে গেছে তা পুনরুদ্ধারের জন্য তাদের ক্ষমতায়ন ও সহায়তা করতে হবে। সমাজে ও মণ্ডলির সুবিধাবাদী পুরুষদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অন্যায্য কাঠামোসমূহ ভেঙ্গে ফেলতে নারীদের যুদ্ধে সহায়তা দিতে হবে, যেন তারা একটি ন্যায্য ও মিলনধর্মী কাঠামোতে বেড়ে উঠতে পারেন। সিনোডাল বা মিলনধর্মী মণ্ডলির বৈশিষ্ট্য: শ্রবণ, বিশ্লেষণ, সংলাপ ও অন্যায্য কাঠামোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেন কেউ যাজকত্ববাদের বা নির্যাতন বা শোষণের শিকার না হয়। এইভাবেই আমাদের সমাজ ও মণ্ডলি সিনোডাল বা মিলনধর্মী হয়ে উঠবে। মণ্ডলিতে এই সিনোডালিটি তখনই সম্ভব যখন আমরা সকলকে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ করে দিতে পারি; আর এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারি যখন সকলে একমত হয়ে কাজ করতে পারি, যখন আমরা নারী পুরুষের বৈষম্যকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারি। যদিও সমাজের ও মণ্ডলির বর্তমান সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত কাঠামো ভেঙ্গে নতুন ক’রে সব কিছু গড়ে তোলা সহজ হবে না।
সংলাপ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ : মণ্ডলিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে খ্রিস্টভক্তদের ভূমিকা বা অংশগ্রহণ খুবই সীমিত; আর পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের কোনো অধিকার নেই বললেই চলে। এখন অবশ্য ধীরে ধীরে অবস্থা কিছু কিছু বদল হচ্ছে, তবে তা খুবই সীমিত। উচ্চ বেতনে উচ্চ পদে সরকারি, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী ও ব্যবসা বাণিজ্য সংস্থায় নারীরা মালিকানা বা পরিচালনা করলেও মণ্ডলিতে বর্তমানে তাদের সেইরকম কোন ভূমিকা নেই। ধর্মব্রতিনী নারীরাও ব্যতিক্রম নয়। আসলে সমাজের বা মণ্ডলির বর্তমান কাঠামোতে সেই রকম কোন সুযোগও নেই। তবে পোপ ফ্রান্সিস নারীদের ভাটিকান কুরিয়ার উচ্চ পদে নিয়োগ দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন যে- সদিচ্ছা থাকলে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা সম্ভব।
সিনোডাল মণ্ডলির রূপরেখায় জেনেছি যে, আমরা যদি শ্রবণ না করে সুন্দর সুন্দর প্রতিবেদন ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করি- তা সিনোডাল মণ্ডলি নয়। একরোখা হয়ে একগুয়েমী করে ও নিজের ধারণায় অনড় থেকে কোনো সংলাপ করা যায় না; আর তা করলেও কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। সংলাপ করতে গেলে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়, সম্মান করতে হয়। সিনোডাল মণ্ডলি হলো শ্রবণকারী মণ্ডলি। খ্রিস্টভক্ত, ধর্মব্রতী-ধর্মব্রতিনী, যাজক, বিশপ ও পোপ সকলেরই উচিত পরস্পরের কথা শোনা; আর সকলের উচিত পবিত্র আত্মার কথা শোনা, ঈশ্বরের কথা শোনা।
সিনোডাল নেতৃত্ব অর্থ হলো দাসের মতই একজন নেতা, যেখানে নারী ও পুরুষ পরস্পরের সহযোগী ও সহভাগী। মণ্ডলিতে অনেক কাজ রয়েছে যার জন্য আবশ্যকীয়ভাবেই যাজকীয় অভিষেকের প্রয়োজন নেই। পোপ ফ্রান্সিস যেভাবে নারীদের মণ্ডলির বিভিন্ন পদ ও দায়িত্ব দিচ্ছেন তা আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। পশ্চিমা অনেক দেশে ধর্মপ্রদেশীয় চ্যাঞ্চেলরের মত গুরু দায়িত্বেও নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা এক সময় শুধুই পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। পোপ ফ্রান্সিস যখন ‘সিনোড’ সংক্রান্ত সিনোড ঘোষণা করেন, তখন অনেকেই মণ্ডলিতে অনেক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছে। কারণ তিনি আহ্বান জানিয়েছেন যেন ঐশ্বজনগণের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ক’রে মণ্ডলি পরিচালনা করা হয়। আর এখন মণ্ডলিতে সেই আলাপ আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন ধর্মপল্লীতে ও ধর্মপ্রদেশে সিনোড কর্মশালা ও আলাপ আলোচনায় সকলের মতামত ও কথা শোনার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
আশা ও চ্যালেঞ্জ : বাংলাদেশের সকল ধর্মপ্রদেশে ও সকল ধর্মপল্লীতেই সিনোড অনুষ্ঠিত হয়েছে। চুড়ান্ত পর্বে জাতীয় পর্যায়েও সিনোড হয়েছে। শেষে ধর্মপ্রদেশ ও ধর্মপল্লী উভয় পর্যায়েই সংশ্লেষণ প্রতিবেদন (Synthesis) করে রোমে পাঠানো হয়েছে। সেই সব সংশ্লেষণে জনগণের যে আশা ও শঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে তা আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মণ্ডলির পক্ষে আর বিচার করার মনোভাব (Judgmental) রাখা উচিত নয়, কাউকে বাদ বা বাইরে না রেখে বরং মণ্ডলিকে হতে হবে অন্তর্ভূক্তিমূলক (Inclusive); এইভাবেই মণ্ডলি ঐশ্ব জনগণকে আপন করে নিতে পারবে।
– জনগণের কাছে এখনও মণ্ডলি যাজকতান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষ নিয়ন্ত্রিত। তাই আমাদের সেমিনারিগুলিতে যে শিক্ষা ও গঠন দেওয়া হয় তা ধর্মপল্লীর প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে ভবিষ্যত যাজকদের গঠন হয় কম। একটা ভয় থেকে যায় যে, যদি কেউ প্রাবক্তিক হয়ে উল্টো স্রোতে গিয়ে কাজ করতে চায় তাহলে হয়তো তাকে থামিয়ে দেওয়া হতে পারে। মণ্ডলিতে পুরুষদের মত নারীদেরও কিভাবে মূল্যায়ন করা যায় তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। মণ্ডলি শুধু যাজকদের নয়; মণ্ডলি খ্রিস্টবিশ্বাসী সকলের- পুরুষ ও নারী সকলের। খ্রিস্টভক্তরা এখন যে গীর্জাবিমূখ হচ্ছে তার প্রতিকার কিভাবে হবে এখন আমাদের সেই কথাই ভাবতে হবে।
– ধর্মপল্লীতে যে ধর্মব্রতিনী সিস্টারগণ সেবাদান করেন, তাদের প্রতি আমাদের যাজকদের দৃষ্টিভঙ্গী কেমন তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। পরিবারে নারীদের যে মর্যাদা বা অবস্থা মণ্ডলিতে ধর্মব্রতিনীসহ নারীদের অবস্থা কি তার চেয়ে ভাল? অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হয় না।
– আমাদের ধর্মপ্রদেশীয় সিনোডে একজন ধর্মব্রতিনী প্রশ্ন করেছেন, সিস্টারদের সঙ্গে রাগ করে কোনো যাজক যদি সিস্টারদের জন্য খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তারা কি করবেন? অথবা যদি যাজকগণ ক্ষমতাবলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা চালায় তাহলে তারা কি করবেন? পরিবারে যেমন নারী, গৃহ-বধূরা তেমনি মণ্ডলিতেও নারী সিস্টারগণ নানা কারণে ও নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন।
– পরিবারে, সমাজে ও মণ্ডলিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের বেশ অবজ্ঞাই করা হয়- বা তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। তবে কাজের জন্য তাদের খোঁজ করা হয়। মনে করা হয় যে মেয়েদের কাজ শুধু রান্নাঘরে ও অন্দরে, বা ধর্মপল্লীতে হলে মনে করা হয় সাক্রিস্টিতেই সিস্টারদের কাজ।
বিভিন্ন ধর্মপল্লী ও ধর্মপ্রদেশ থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের বিষয় বস্তু :
– খ্রিস্টভক্তদের অনেকেই পোপ ফ্রান্সিসের এই উদ্যোগ ও এর উন্নয়নকে সমর্থন করেছেন। পোপ ফ্রান্সিস পুরুষ খ্রিস্টভক্তদের জন্য স্থায়ী ডিকনপদের পাশাপাশি খ্রিস্টযাগের পাঠক (Lectors) ও সেবক (Acolyte) পদ স্থাপন করেছেন যেন উপাসনায় খ্রিস্টভক্তরা স্বক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং সেখানে নারীরাও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এই পদগুলি মণ্ডলির অতি প্রাচীন পদ, যা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয়, খ্রিস্টভক্তরা স্থানীয় মণ্ডলিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও যেন অংশগ্রহণ করতে পারেন- তাও পোপ ফ্রান্সিসের ইচ্ছা।
– সিনোডালিটি নিয়ে আলোচনায় যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে তা হলো পরিবারে, সমাজে ও স্থানীয় মণ্ডলিতে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকা ও নারী নেতৃত্বের অভাব। এই বিষয়টি বিশেষভাবে নারীদের মধ্যে হতাশা, আশাভঙ্গতা ও মোহমোচনের সঞ্চার করছে। ধর্মপ্রদেশ ও ধর্মপল্লীগুলি থেকে প্রাপ্ত সব প্রতিবেদনেই যাজকদের ক্ষমতা কমানো ও নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয় আকাঙ্খা ব্যক্ত করা হয়েছে। আর অধিকাংশ খ্রিস্টভক্তদের অনুভূতি হলো যে- তাদের কথা প্রায়ই শোনা হয় না।
– ঐসব প্রতিবেদনে যাজকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনা, তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও মদ্যপানের মত অনাদর্শিক বিষয়গুলি উঠে এসেছে। খ্রিস্টভক্তরা মনে করেন যে, এই বিষয়গুলি মণ্ডলির বড় ক্ষতি করছে। এই সব কারণে অনেক খ্রিস্টবিশ্বাসী ভক্ত গীর্জায় আসেন না ও তাছাড়া বাণী প্রচার ও বিশ্বাস বিস্তার ক্ষেত্রে তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিশপগণের কাছে আবেদন রাখা হয়েছে যেন তাঁরা এই বিষয়গুলি সমাধানের উদ্যোগ নেন।
– অনেক খ্রিস্টভক্তই চান একটি বৈষম্যহীন মণ্ডলি গড়ে উঠুক যা হবে তাদের মণ্ডলি- যে মণ্ডলিতে নারী পুরুষের মধ্যে কোনো বিভাজন বা বৈষম্য থাকবে না। বিশেষভাবে ব্রতধারিণী নারীরা বলেছেন যে ধর্মপল্লী বা ধর্মপ্রদেশের কোনো পর্যায়েই তাদের কাথা শোনা হয় না; বা তাদের কথার কোনো দাম দেওয়া হয় না। পরিবার ও সমাজের মতই মণ্ডলিও পুরুষ শাষিত। তারা এমন একটি মণ্ডলি চায় যেখানে তাদের কথার বা মতামতের দাম বা মূল্য দেওয়া হবে।
– পবিত্র আত্মা মণ্ডলিকে প্রেরণা দিয়ে আহ্বান জানাচ্ছেন যেন সে সচল ও জীবন্ত হয়ে ওঠে। নারীদের ও পুরুষদের পাশাপাশি মণ্ডলির উচ্চতর পদে স্থান করে নিতে হবে; যেখানে পুরুষদের মত তাদেরও থাকবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব। বর্তমান বিশ্বে নারীরা সরকারের উচ্চতম পদে, এমন কি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারীদের নেতৃত্ব ধীরে ধীরে শক্তভাবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
– বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে মণ্ডলিকে আর অন্তর্মূখী ও পশ্চাদপদ হয়ে থাকা সম্ভব নয় বা উচিতও নয়। আমাদের হতে হবে প্রাবক্তিক; আমাদের সাহস সঞ্চার ক’রে- নির্ভয়ে দরিদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠি, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও যারা পড়ে আছেন সমাজের প্রান্তসীমায়, তাদের বিষয় কথা বলতে হবে। আমাদের সাহস ক’রে তাদের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে কথা বলতে হবে। তাদেরও জীবন রক্ষার অধিকার আছে। শোষিত ও নির্যাতিত মানুষদের মধ্যে ঈশ্বরকে আবিষ্কার ক’রে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্বও পালন করতে হবে; তাদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে হবে। মণ্ডলি চায় যেন আমরা নারীদেরও এই যাত্রায় সঙ্গে নিয়ে চলি।
– আমাদের সমাজে যে লিঙ্গ বৈষম্য আছে, কিশোরী মেয়েদের অসচেনতা, গৃহে বা পরিবারে সহিংসতা, পণ বা যৌতুক প্রথা, নারীদের অধিকারহীনতা এবং নারীদের আভ্যন্তরীণ শক্তি ও তাদের আশা আকাঙ্খার দিকে মণ্ডলিকে অতি সত্ত্বর নজর দিতে হবে। সিনোডাল মণ্ডলিতে কোনো মানুষই বড় বা ছোট নয়- নারী বা পুরুষ উভয়েই ঈশ্বরের কাছ থেকে সমান মর্যাদা ও অধিকার লাভ করেছেন।
উপসংহার : ঈশ্বর নিজেই সকল মানুষকে পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছেন। এই পরিবর্তন এক জনের কাজ নয়, এই কাজ সংশ্লিষ্ট সকলেরই। এই পরিবর্তন আসবে সকলের সম্মিলিত ধ্যান, অবধারণ ও বাছাই করার মধ্য দিয়ে। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের ভাষায় পুরাতন মনোভাব নিয়ে জীবন-যাপন করা মানেই হলো আত্ম হনন, পরিবেশ হনন ও গণহত্যা বা হননের সামিল।
২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি ঈশ্বর জননী মারীয়ার মহাপর্ব ও বিশ্ব শান্তি দিবসের বাণীতে পোপ ফ্রান্সিস নারীদের বিষয় একটি ইতিবাচক কথা বলেছিলেন, “নারীরা শান্তি দান করে ও শান্তি স্থাপনে মধ্যস্থতা করে; তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশ থাকতে হবে। নারীরা যদি তাদের প্রতিভা ও সক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পান, এই বিশ্বের সকল মানুষ পরস্পরের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত ও স্থায়ী শান্তিতে থাকবেন। তাই নারীর বিজয় মানে সমস্ত বিশ্বের মানব জাতির বিজয়”।
নারীরা জানে কিভাবে পরস্পরের হাত ধরে পথ চলতে হয়- তারাই পৃথিবীতে স্বর্গ রচনা করতে পারবেন। সিনোডাল পথে চলার ইচ্ছা ও সৃজনশীলতা নারীদের আছে। তাদের কাছ থেকে পুরুষদের অনেক কিছুই শিখার আছে। নারীরা যেমন পুরুষদের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না, পুরুষরাও তেমনই নারীদের ছাড়া থাকার কল্পনাও করতে পারেন না। ঈশ্বর মানুষকে পুরুষ ও নারী করে সৃষ্টি করেছেন; তাদের সমান মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। নারী ও পুরুষকে পরস্পরের জন্য সৃষ্টি করেছেন। উভয়কে সিনোডাল পথে চলার জন্য সৃষ্টি করেছেন।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
ক্যাথলিক ডাইয়োসিস, রাজশাহী।