ফাদার পল গমেজ
প্রতি বছরই সারা বিশ্ব মণ্ডলির সাথে একাত্ম হয়ে আমরা সকল খিস্ট বিশ্বাসীগণ যিশুর পুনরুত্থান উৎসব উদযাপন করি। আমরা এই উৎসব উদযাপনের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অর্থাৎ চল্লিশ দিন ধ্যান-প্রার্থনা, উপবাস, ত্যাগস্বীকার ও অভাবী অসহায় ভাই-বোনদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করার মধ্য দিয়ে প্রস্তুতি নিই । একই সাথে আত্মশুদ্ধি লাভের জন্য, পাপের অনুতাপ করে, সংস্কার লাভে পাপের ক্ষমা পাই যা সত্যিকার ভাবে আমাদের একটি বড় আধ্যাত্মিক অর্জন। যিশুর পুনরুত্থান আমাদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি, আমাদের পরিত্রাণ ও যিশুর পুনরুত্থানের অংশীদার হয়ে আমরা নতুন জীবন লাভ করি।
স্বর্গীয় পিতার ইচ্ছা তথা তাঁর মুক্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যিশু এ জগতে প্রেরিত হয়েছিলেন। ঈশ্বর মানব জাতিকে পাপের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিদানের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করতে তাঁর নিজ পুত্রকে এ জগতে প্রেরণ করলেন; যেন যিশু পুত্র ঈশ্বর রূপে সেই কাজ সম্পন্ন করেন। আর মানব মুক্তির কাজ যিশু তাঁর যাতনাভোগ, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণভাবে সাধন করেছেন। যিশুর পুনরুত্থান মুক্তির ইতিহাসে ও আমাদের প্রকৃত খ্রিস্টবিশ্বাসের সঠিক ও শক্ত ভিত্তি। যিশু সত্যিই মৃত্যুর শক্তিকে পরাভূত করে বিজয়ের মহাগৌরবে পুনরুত্থিত হয়ে স্বর্গে পিতার পার্শ্বে সমাসীন; – একথা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
যিশু যে মৃত্যুকে জয় করে পুনরুত্থিত হয়েছে তার প্রমাণ – শিষ্যদের নিজ চোখে দেখা স্বাক্ষ্য ও তাদের সামনে পুনরুত্থিত যিশুর বহুবার দর্শন দান। যিশুর প্রিয় শিষ্য সাধু যোহন তার মঙ্গলসমাচারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন কিভাবে রবিবার দিন ভোরে মাগদালার মারিয়া যিশুকে কবরে খুঁজে পাননি, বরং তিনি দেখেছেন সমাধিটা শূণ্য। তাঁর আপত্তি ছিল যিশুকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। একই ভাবে পিতর ও অন্য একজন শিষ্য সমাধি গুহার ভিতরে প্রবেশ করে যিশুর দেহ খুঁজে পায়নি; শুধুমাত্র ক্ষোম কাপড়ের ফালিগুলো ছড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন এবং তাঁর অন্তরে জেগে উঠল বিশ্বাস এই ভেবে যে, শাস্ত্রবাণী পূর্ণ হয়েছে ‘যিশুকে মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থান করতে হবে’ (যোহন ২০: ১-৯) । যিশু যে পুনরুত্থিত হয়েছেন দু’জন স্বর্গদূত সেই যিশুভক্ত নারীদের সেই কথায় জানিয়েছিলেন ‘যিনি জীবিতই আছেন তাঁকে তোমরা মৃতদের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছ কেন! তিনি এখানে নেই, তিনি তো পুনরুত্থিত হয়েছেন’ । যিশুর সেই কথা তখন তাদের মনে পড়ে যায় যে, “মানবপুত্রকে একদল পাপী মানুষের হাতে সমর্পিত হতে হবে, তাঁকে ক্রুশ বিদ্ধ হতে হবে, তারপর তৃতীয় দিনে তাঁকে পুনরুত্থানও করতে হবে”। যিশুর এই পুনরুত্থান সংবাদ অন্য এগারোজন শিষ্যকে তারা জানালো যদিও এসব কথা তারা বিশ্বাস করতে চাইলো না। কিন্তু পিতর নিজে গিয়ে দেখল যিশু সমাধিতে নেই, সমাধি সম্পূর্ণভাবে শূণ্য (লুক ২৪:১-১২)
তাহলে এখন আমাদের কাছে খুবই স্পষ্ট যে, যিশু সত্যিই পুনরুত্থিত; – যিনি মৃত্যুকে জয় করে দেখিয়েছেন যে তিনি সত্যিকারভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী। যিশুর সমাধিটি শূণ্য অথ্যাৎ যিশু সেখানে আর নেই, তিনি জীবিত হয়ে উঠেছেন। মৃত্যু তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি। জগৎ সংসারের শক্তি তাঁকে কোনভাবেই আঁকড়ে রাখতে পারেনি বরং তিনি সত্যিকার ভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী। আর পরবর্তীতে যখনই তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য ও অন্যান্যদের দেখা দিয়েছেন তিনি নিজেই প্রকাশ করেছেন যে তিনি পুনরুত্থিত। যোহন তার মঙ্গলসমাচারের ২০ ও ২১ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন পুনরুত্থিত যিশু মাগদালার মারিয়াকে দেখা দিয়ে বলেছিলেন যে, তুমি আমার ভাইদের গিয়ে জানাও যে যিনি আমার ও তোমাদের পিতা, আমার ও তোমাদের ঈশ্বর আমি উর্ধ্বলোকে তাঁরই কাছে ফিরে যাচ্ছি। মাগদালার মারিয়া যিশুর দেখা পেয়ে এতো আনন্দিত হয়েছিল যে, সে সমস্ত কিছু এগারজন শিষ্যকে একথা জানিয়েছিল । তাই যিশুর পুনরুত্থানে সংবাদ লাভে শিষ্যগণের ভিতরে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যায়; তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়ে উঠে।
অন্যদিকে পুনরুত্থিত যিশু শিষ্যদের সত্যিকার জীবনাহ্বান কি তা সুনিশ্চিত করার জন্য যিশুর নির্দেশে তারা গভীর জলে জাল ফেলল এবং প্রচুর মাছ ধরল; যা ছিল সত্যিকারভাবে তাদের জন্য আশ্চর্য সাফল্য। একই ভাবে যিশু রুটি ও মাছ সকলের হাতে দিলেন যেন তারা সকালের খাবারটা সেরে ফেলে (যোহন ২১: ১-১৩)। আসলে মঙ্গলসমাচারের এসব ঘটনাগুলো সত্যিকারভাবে প্রমাণ ও প্রকাশ করে যে, যিশু সত্যিই পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং এর মূল রহস্য হলো মানব মুক্তি বা পরিত্রাণ। অপরদিকে, এম্মাউসের পথে দু’জন শিষ্যের সাথে পুনরুত্থিত যিশুর দীর্ঘ পথের যাত্রা ও সংলাপ, যেখানে তিনি খুবই মনোযোগ-সহকারে যিশুকে কেন্দ্র করে যেরুসালেমে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা শুনছিলেন। অর্থ্যাৎ সেই দু’জন শিষ্য নিজেরাই সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে, যিশু সত্যিই পুনরুত্থিত হয়েছেন; কারণ কয়েকজন স্ত্রীলোক যিশুর মৃতদেহ কবরে দেখতে পাননি এবং স্বর্গদূতগণ জনিয়েছেন যে, যিশু বেঁচে উঠেছেন। যিশু গভীর আগ্রহে তাদেরকে পবিত্র শাস্ত্রের ও প্রবক্তাদের বাণীগ্রন্থ থেকে খ্রিস্ট সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সবই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন এবং সর্বশেষে রুটি ছেড়া অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা পুনরুত্থিত যিশুকে চিনতে পেরেছিল ( লুক ২৪: ১৩-৩৫)।
প্রকৃতপক্ষে পুনরুত্থিত যিশু নিজেই ধীরে ধীরে তাঁর পুনরুত্থানের সংবাদ শিষ্য ও অন্যান্যদের কাছে প্রকাশ করেছেন। তবে এটা খুবই লক্ষ্যনীয় যে, পুনরুত্থিত যিশুকে শিষ্যরা যখনই দেখতে পেয়েছেন প্রথমে তাঁকে চিনতে তাদের সত্যিই অসুবিধা হয়েছে; কিন্তু যিশু নিজেই যখন কথা বলছেন এবং নিজের পরিচয়ের বিষয় ইঙ্গিত দিয়েছেন তখন তারা যিশুকে চিনতে ভুল করেনি। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, কারো পারলৌকিক পুনরুত্থান ঘটলে তাঁর দেহের পরিবর্তন হয় এবং চেহারাও বদলে যায় ( ১ করি ১৫: ৪২-৪৪)। অন্যদিকে যিশু যে পুনরুত্থিত হয়েছেন সে ব্যাপারে শিষ্যদের বিশ্বাসের দুর্বলতাও একটি বিশেষ কারণ ( মার্ক ১৬: ১১-১৪)।
যিশুর পুনরুত্থান আমাদের জীবনের মুক্তি এটা সত্যিই বাস্তব ও খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে গ্রহণীয়। আমরা যিশুকে বিশ্বাস করি এবং এটাও স্বীকার করি তিনি আমাদের মুক্তিদাতা ও ত্রাণকর্তা। কারণ তাঁর যাতনাভোগ, ক্রুশীয় মৃত্যু ও পুনরুত্থান যার মধ্য দিয়ে আমরা সকলেই পেয়েছি পাপের ক্ষমা, নতুন জীবন ও জীবনের পুর্ণ মুক্তি। মণ্ডলির শিক্ষা, পবিত্র শাস্ত্রবাণী ও মণ্ডলির ঐতিহ্যগত শিক্ষা সর্বোপরি প্রেরিতগণের শ্রদ্ধামন্ত্রে (Apostles Creed) আমরা যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানে বিশ্বাস করি ও তা স্বীকারও করি। কারণ যিশু মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্য দিয়েই গোটা মানবজাতি তথা জগতের মুক্তি এনেছেন।
যিশুর পুনরুত্থান পর্ব উদযাপনে আমাদের যে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি আমরা নিয়ে থাকি তা অবশ্যই জীবনে মুক্তিলাভে সহায়তা করে। কারণ আমরা এ জগত সংসারের অনেক কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়ি এবং সাংসারিক মোহ-মায়ায় আসক্ত হয়ে পড়ি। তাই যিশু তাঁর যন্ত্রণাময় মৃত্যু ও গৌরবময় পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষা দিতে চান যেন আমরাও পাপের আসক্তি ত্যাগ করি, অনুতাপ করি ও পাপের ক্ষমা লাভের মধ্য দিয়ে যিশুর পুনরুত্থানের অংশীদার হয়ে উঠতে পারি। বিগত বছরগুলোতে আমাদের যেসব ঘাটতিগুলো ছিল সেগুলি যেন এবছর যিশুর পুনরুত্থান পর্ব উদযাপনের মধ্য দিয়ে পুরণে সচেষ্ট হই এবং সুন্দর মন ও চিন্তা, হৃদয়ের পবিত্রতা ও পুর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পাষ্কাপর্ব তথা পুনরুত্থান পর্ব উদযাপন করতে পারি। আমরা পুনরুত্থিত যিশুর সংস্পর্শে এসে যেন নবজীবন লাভে ধন্য হতে পারি। পরস্পরের সঙ্গে একত্রে যেন পুনরুত্থানের আনন্দ, শান্তি ও ঐশ ভালবাসা সহভাগিতা করে আত্মার তথা জীবনের মুক্তির স্বাদ লাভ করতে পারি। পুনরুত্থিত প্রভু যিশু যেন আমাদের ঐশ আশির্বাদ দানে ধন্য করেন। সুন্দর, আনন্দপূর্ণ ও উৎসব মূখর হোক এবারের পুনরুত্থান উৎসব তথা পাষ্কা পর্ব।