গত ২৪ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের বিশপস্ হাউজে অবস্থিত সামাজিক গঠন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ২০০০-২০০৬ খ্রিস্টাব্দ সময়সীমার মধ্যে অভিষিক্ত ধর্মপ্রদেশীয় যাজকদের নিয়ে নবায়ন কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। নবায়ন কোর্স মূল বিষয় ছিল: বর্তমান জগত: যাজকীয় জীবন এবং পালকীয় দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ধর্মপ্রদেশীয় যাজক ভ্রাতৃসংঘ (বিডিপিএফ) এর আয়োজনে ও ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশীয় যাজক ভ্রাতৃসংঘের সার্বিক সহযোগিতায় এই নবায়ন কোর্সে সারা বাংলাদেশ থেকে মোট ২৫ জন অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও নবায়ন কোর্স পরিচালনা করার জন্য বিডিপিএফ সভাপতি ও সেক্রেটারীসহ আরো ৬ জন যাজক কোর্স চলাকালীন সময়ে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশ থেকে যাজকগণ সোমবার বিকালে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশে আসেন এবং সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনার মধ্য দিয়ে এই নবায়ন কোর্সের যাত্রা শুরু করেন। যাজক ভ্রাতৃসংঘের প্রেসিডেন্ট ফাদার মিন্টু লরেন্স পালমা সকলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমরা এই কোর্সের মধ্যদিয়ে পরস্পরের সাথে সহভাগিতা করে আমাদের সময়কে রিলাক্সের মাধ্যমে কাটাবো। আমি সকল অংশগ্রহণকারী ভাই পুরোহিতকে ধন্যবাদ দেই কেননা, আপনারা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এই নবায়ন কোর্সে অংশগ্রহণ করেছেন।

মঙ্গলবার সকাল ৬:৩০ মিনিটে বিশেষ খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ পল পনেন কুবি, সিএসসি। সকাল ৮:৩০ মিনিটে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশীয় যাজক ভ্রাতৃসংঘের ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় কৃষ্টিতে অংশগ্রহণকারী ও অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ পনেন কুবি, সিএসসি। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহের ভিকার জেনারেল ফাদার শিমন হাচ্ছা, ফাদার জয়ন্ত গমেজ এবং অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিডিপিএফের সভাপতি ফাদার মিন্টু লরেন্স পালমা। প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে বিশপ মহোদয় কোর্সের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। স্বাগত বক্তব্যে বিশপ মহোদয় বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশের যাজকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজেদের জীবনের দিকে দৃষ্টি দিতে বলেন। বিশেষভাবে আহ্বান রাখেন যাজকগণ যেন তাদের জীবনে প্রার্থনাশীল, সহজ-সরল, অঙ্গীকারবদ্ধ, ত্যাগী, ধ্যানী ও নীরবতায় মগ্ন থেকে তাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাপন করেন। বর্তমান চ্যালেঞ্জপূর্ণ এই সময়ে সকল যাজককে সহজ-সরল ও ধ্যানময় জীবন-যাপনের জন্য উৎসাহিত করেন এবং নিজেদের জীবনাচরণের মধ্যদিয়ে একেক জন খ্রিস্টের সাক্ষী হয়ে উঠার জন্য আহ্বান জানান।

নবায়ন কোর্সের মূল বক্তা ফাদার জয়ন্ত এস, গমেজ “যাজকদের পালকীয় সেবাকাজ ও চ্যালেঞ্জসমূহ” উপস্থাপনা করতে গিয়ে বলেন, যাজকীয় জীবনে নির্মল আনন্দের সাথে প্রতিদিনই শত শত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যাজকদেরকে সর্বদাই প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি হিব্রুদের কাছে ধর্মপত্রের উদ্বৃত্তি দিয়ে বলেন, “প্রতিটি মহাযাজক মানুষের মধ্য থেকে মনোনীত হন এবং তিনি পরমেশ্বরের সেবাকার্যে মানুষের প্রতিনিধি রূপেই নিযুক্ত হয়ে থাকেন। যাতে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি অর্ঘ্য ও বলি নিবেদন করতে পারেন।” তিনি আরো বলেন, জনগণের সঙ্গে যুক্ত থাকা ও জনগণের হয়ে উঠাও আমাদের যাজকীয় জীবনের একটি আনন্দ আবার অন্যদিকে চ্যালেঞ্জও বটে। তাই, আমাদের যাজকীয় জীবনের আচার-আচরণ, ব্যবহার, স্বভাব ও মার্জিত জীবন দৃষ্টান্ত ও খ্রিস্টীয় শিক্ষা দ্বারা নিজেদেরকে পরিচালিত করতে হবে এবং সর্বদাই সকলের সঙ্গে আন্তরিক, অকৃত্রিম, আস্থাশীল ও ভালোবাসাপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে হবে।

১ম দিনে অংশগ্রহণকারী যাজক বরিশাল ডায়োসিসের গৌরনদী ধর্মপল্লীর পালক-পুরোহিত ফাদার রিংকু গমেজ সহাভাগিতা করেন ‘ যাজকীয় জীবনে খ্রিস্টভক্তগণ’; ঢাকা আর্চ-ডায়োসিসের শুলপুর ধর্মপল্লীর পালক-পুরোহিত ফাদার লিন্টু ফ্রান্সিস কস্তা ‘রোগী ও অসুস্থ পীড়িতদের সেবা’; রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ক্যাথেড্রাল ধর্মপল্লীর পালক-পুরোহিত ও ভিকার জেনারেল ফাদার ফাবিয়ান মারান্ডী ‘পাল-পুরোহিত ও সহকারীদের সাথে সম্পর্ক’ নিয়ে উপস্থাপনা রাখেন।

বিকালে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ফাদার শিমন হাচ্ছা ৩৭ বছরের যাজকীয় জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে পালকীয় জীবন সহভাগিতা করে যাজকদেরকে সহজ-সরল জীবনের অধিকারী ও সর্বাবস্থায় খ্রিস্টভক্তদের পাশে থাকার জন্য আহ্বান রাখেন।

নবায়ন কোর্সের ২য় দিনে ‘স্থানীয় মণ্ডলির ভবিষ্যৎ ও দিক নির্দেশনা’ বিষয়ক মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ফাদার দিলীপ এস, কস্তা। তিনি তার উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশ মণ্ডলিকে স্থানীয় মণ্ডলি হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে আমাদের আরো বেশি চিন্তা ও কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। সক্রিয় ও স্থানীয় মণ্ডলি গঠনের জন্য আমাদের স্থানীয় সম্পদের যথার্থ ও দূরদর্শী ব্যবহার করতে হবে। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, ধর্মপ্রদেশীয় যাজকগণ হচ্ছেন বিশ্বাসের সাক্ষ্যদানকারী এবং জনগণের সেবক।

সকালের অংশে অংশগ্রহণকারী যাজক খ্রিস্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রের পরিচালক ও সাপ্তাহিক প্রতিবেশীর সম্পাদক ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু ‘যাজক ও বর্তমান যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’; ময়মনসিংহের বালুচরা ধর্মপল্লীর পালক-পুরোহিত ফাদার প্লিনসন মানখিন ‘ধর্মব্রতী-ধর্মব্রতীণিদের সাথে যাজকের সম্পর্ক’; ঢাকার ফাওকালের পালক-পুরোহিত ফাদার ম্যাক্সওয়েল টমাস ‘পালক পুরোহিত হিসেবে সেবাকাজ’; পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারীর সহকারী পরিচালক ফাদার রোদন রবার্ট হাদিমা ‘শিশুমঙ্গল, ওয়াইসিএস, সেবকদল’; রাজশাহী ডায়োসিসের উন্নয়ন বিষয়ক পরিচালক ফাদার উইলিয়াম মুরমু ‘বিপরীত লিঙ্গের সাথে পরিপক্ক সম্পর্ক’ বিষয়ে সহভাগিতা করেন।

নবায়ন কোর্সের ২য় দিনের বিকালের অংশে যাজকীয় জীবনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে যাওয়া ফাদার পিটার রেমা যাজকদের আধ্যাত্মিক জীবন বিষয়ে সহভাগিতা করতে গিয়ে বলেন, জীবন ও কর্মের মধ্যদিয়ে প্রত্যেক যাজককে তাদের আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করতে হবে। চটগ্রাম আর্চ-ডায়োসিসের ভিকার জেনারেল ও পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারীর অধ্যাপক ফাদার লেণার্ড সি রিবেরু ‘জনগণের কাছে ধর্মপ্রদেশীয় যাজক হিসেবে আমাদের পরিচয়’; খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রের পরিচালক ফাদার বাবলু সি, কোড়াইয়া ‘বৈষয়িক সম্পদ ও আমাদের দায়বদ্ধতা’ বিষয়ে সহভাগিতা করেন। সন্ধ্যায় দলগত প্রার্থনা, উন্মুক্ত আলোচনা ও আহারের মধ্যদিয়ে নবায়ন কোর্স এর আলোচনার অংশ শেষ হয়।

নবায়ন কোর্সের তৃতীয় দিনের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের ৪টি ধর্মপল্লীতে তীর্থযাত্রা। এই তীর্থ যাত্রার মধ্যদিয়ে কোর্সে অংশগ্রহণকারী যাজকগণ ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের স্থানীয় অংশগ্রহণকারী মণ্ডলির একটি বাস্তবমূখী অভিজ্ঞতা লাভ করেন। বারোমারি তীর্থ স্থান পরিদর্শনের সময় যাজকগণ সম্মিলিতভাবে খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন। এই খ্রিস্টযাগে মূলত ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের সকল খ্রিস্টভক্ত, কাটেখ্রিস্ট মাস্টার ও ব্রতধারি-ব্রতধারিণী, যাজকবৃন্দ এবং বিশপ মহোদয়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়। সারাদিনব্যাপী বিভিন্ন মিশনে তীর্থ যাত্রা করার মধ্যদিয়ে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের নবায়ন কোর্সের আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘোষণা করেন বিডিপিএফের সভাপতি ফাদার মিন্টু পালমা।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার বাবলু কোড়াইয়া

Please follow and like us: