ফা. সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিনিধি
ভূমিকা : সিনোড “বিশপগণের ধর্মসভা” হলো পোপের অধীনে ক্যাথলিক বিশপদের একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। পোপ ৬ষ্ঠ পল, দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভায় যোগদানকারি বিশপদের ভবিষ্যত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গী এবং মহাসভার তাৎপর্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিনোড বা বিশপীয় ধর্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। The word “synod”, derived from two Greek words syn meaning “together” and hodos meaning “road” or “way”, means a “coming together. যা বাংলায় বিভিন্নভাবে বলা যায়, একসঙ্গে চলা বা একসঙ্গে পথচলা বা একসঙ্গে যাত্রা। মণ্ডলির প্রচলিত ধারণায় সিনোড অর্থ হলো, প্রেরিতদূতদের উত্তরাধিকারী মণ্ডলির বিশপগণ- জনগণের সঙ্গে, পরস্পরের সঙ্গে এবং মণ্ডলির প্রধান পোপের সঙ্গে- একসঙ্গে পথ চলবেন। তাই বলা যায়, সিনোড হলো ক্যাথলিক চার্চের একটি ধর্মীয় সভা, যে সভায় গোটা বিশ্ব থেকে প্রতিনিধি বিশপগণ পোপের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরস্পরের মধ্যে পালকীয় সেবা, অভিজ্ঞতা বিনিময়, নানা তথ্য এবং চার্চের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করেন। এভাবেও বলা যায়, “সিনোড হলো, বিশ্ব ক্যাথলিক বিশপ প্রতিনিধিদের একটি ধর্মীয় সভা, যারা সর্বজনীন মণ্ডলির জন্য তাদের পরামর্শ দিয়ে পোপকে সহায়তা প্রদান করেন।”
১. সিনোডাল চার্চ : সিনোডাল চার্চ হলো “মণ্ডলির একত্রে যাত্রা” অন্য কথায় “মিলন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে খ্রিস্টভক্তগণের একত্রে যাত্রা।” যখন বলা হয় খ্রিস্টভক্ত সমাজ- তখন এই খ্রিস্টভক্ত সমাজের মধ্যে রয়েছেন “যুব সমাজ।” যুব সমাজ খ্রিস্টভক্ত হিসেবে গোটা মণ্ডলি থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কোনো গোষ্ঠী নয়। এই আলাদা না হলেও মণ্ডলিতে যুব সমাজের রয়েছে আলাদা পরিচয়, আলাদা অবস্থান ও আলাদা দায়িত্ব।
২. যুব সমাজ মণ্ডলির বীজ : যুব সমাজ হলেন মণ্ডলিতে ফসলের বীজসরূপ। বীজের মধ্যে এক গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। বীজ যে বেড়ে ওঠে- আমরা কিন্তু চোখে দেখি না। কিন্তু যখন পরিণত হয় তখন দেখি তার মধ্যে উৎপাদন। একশো গুণ, দু’শো গুণ ফসল ফলে। আরো একটি বড়– রহস্য হলো- একই মাটিতে বিভিন্ন বীজ থেকে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন। সব ধরনের ফসল কিন্তু মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি। (ভালো বীজ ও ভালো মাটি)।
৩. মণ্ডলিতে নানা আহ্বান : “নানা সেবাকর্ম আছে, তবে যাকে সেবা করা হয় সেই প্রভু কিন্তু এক। নানা কর্মক্রিয়াও আছে তবে সকলের অন্তরে সব কিছুই যিনি করে থাকেন সেই পরমেশ্বর কিন্তু এক। ঐশ আত্মাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা প্রত্যেককে দেওয়া হয় সকলেরই মঙ্গলের জন্য। একজনকে পবিত্র আত্মা দান করেন প্রজ্ঞার ভাষা, আর একজনকে সেই পবিত্র আত্মাই দান করেন ধর্মজ্ঞানের ভাষা, আর একজন সেই আত্মাই দান করেন পরম বিশ্বাস। কাউকে আবার একই আত্মা দান করেন রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা। অন্য কাউকে নানা অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতা, অন্য একজনকে প্রাবক্তিক বাণী ঘোষণা করার ক্ষমতা, অন্য কাউকে নানা আত্মিক শক্তির সরূপ বিচার করার ক্ষমতা। অন্য কাউকে নানা অজ্ঞাত ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা। অন্য কাউকে আবার সেই ভাষা বুঝিয়ে দেবার ক্ষমতা। কিন্তু এই সমস্ত কিছুই সেই এক অদ্বিতীয় আত্মার কাজ। তাঁর আপন ইচ্ছ মতো যিনি এক একজনকে এক এক বিশেষ শক্তি দিয়ে থাকেন (১ম করি ১২:৫-১১)।”
৪. মণ্ডলির যোগ্য কর্মচারি : (মথি ২৫:১৪-৩৩) আমরা পেয়েছি হয়ে ওঠার জন্য যেনো অন্যকে দিতে পারি। আমরা ধ্যান করতে পারি এই তিন কর্মচারির মধ্যে আমার অবস্থান কোথায় ।
৫. সিনোডাল চার্চে ঐক্যতা : এই নানা আহ্বান মিলে হলো চার্চের ঐক্যতা- এবং নানা বর্ণে, নানা প্রয়োজনে একসঙ্গে যাত্রা। চার্চ এতো সুন্দর কারণ এখানে রয়েছে প্রতিভার বৈচিত্র, কর্মের বৈচিত্র, ভাষার বৈচিত্র, পেশার বৈচিত্র। যে সমাজ থেকে শিক্ষক হচ্ছেন- সেই সমাজ থেকে আবার সিস্টার হচ্ছেন, ফাদার হচ্ছেন, নার্স হচ্ছেন- আরো কতো কী। সেই একই মাটিতে নানা ফসল, একই বাগানে বিভিন্ন ফুল ফুলের মতো।
৬. যুবসমাজ ফ্রন্ট লাইনার : ফ্রন্ট লাইনার হলো, যারা আগে আগে থাকে। যারা চ্যালেঞ্জ নিতে জানে। যারা ভাঙ্গতে জানে গড়তে জানে। যারা মৃত্যুকে ভয় করে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১১৫,৫০০ স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন। তারা সবাই ছিলেন ফ্রন্ট লাইনার। আগে বলা হতো- পিতা-মাতা যেমন সন্তান হবে তেমন। এখন যদি ঘুরিয়ে বলি- যুব সমাজ যা ভাবেন সমাজ হবে তেমন। কোন্ অর্থে এই বাক্যটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে ? প্রথমতঃ যুব সমাজ- সমাজকে বদলে দেবার ক্ষমতা রাখেন। সন্তানগণ যদি তাদের বাবা-মাকে বলেন- চলো গির্জায় যাই। চলো প্রার্থনা করি। বাবা-মা কী ফেলতে পারবেন ? তাই বলছি একসঙ্গে যাত্রা পথে পরিবারে তথা সমাজে যুবগোষ্ঠী হলেন ফ্রন্ট লাইনার।
৭. এসো দেখে যাও : “এসো দেখে যাও,” খ্রিস্টের একটি আহ্বান। দেখতে যাওয়াটা আমাদের স্বভাবের মধ্যে রয়েছে। অন্যের কাছ থেকে শুনা আর নিজ চোখে দেখার মধ্যে অনেক তফাৎ। যিশু বললেন, এসো দেখে যাও। আর তারা সেখানে সারাদিন ছিলেন। নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। যুব সমাজকে উদ্দেশ্য করে পোপ বলেছেন, তোমরা অলিতে গলিতে যাও আর নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করো। অন্যের কাছ থেকে শুনে নয় বরং নিজ চোখে দেখো। ফার্স্ট হ্যান্ড লুক।
৮. হৃদয়ের কান দিয়ে শুনো : আমরা যদি পরিবারে পরিবর্তন চাই, সমাজে বা মণ্ডলিতে পরিবর্তন চাই তাহলে আমাদের শুনতে হবে। পোপ বলছেন, তোমরা হৃদয়ের কান দিয়ে শুনো- দেহের কান দিয়ে নয়। কারণ দেহের কান অনেক সময় অসুস্থ থাকে। যুব সমাজের এই গুণটি অবশ্যই অর্জন করতে হবে- যেনো তারা হৃদয়ের কান দিয়ে শোনার আগ্রহ গড়ে তোলে। যোহনের ১ম ধর্মপত্রে যেমনটি বলা হয়েছে, “যা আদি থেকেই ছিল, আমরা যা শুনেছি, নিজেদের চোখেই যা দেখেছি, দু’চোখ ভরেই দেখেছি, আমাদের হাত যা স্পর্শ করেছে, সেই জীবনসরূপ স্বয়ং বাণীর কথাই এখন বলছি। সেই জীবন তো সত্যিই প্রকাশিত হয়েছে। আমরা তা দেখেছি আর সে বিষয়ে সাক্ষীও দিচ্ছি। যে শাশ্বত জীবন পরম পিতার কাছেই ছিল আর আমাদের সামনে যা প্রকাশিত হয়েছে, সেই জীবনের কথাই এখন তোমাদের জানাচ্ছি। আমরা নিজেরা যা দেখেছি আর যা শুনেছি, তা তোমাদের জানাচ্ছি, যাতে আমাদের সঙ্গে তোমরাও সেই মিলন বন্ধনে মিলিত হতে পার, যে মিলন বন্ধনে পরম পিতার সঙ্গে এবং তাঁর পুত্র যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে আমরা নিজেরাই মিলিত হয়ে আছি (১:১-৩)।”
৯. যুব সমাজকে শোনার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে : মণ্ডলিতেও অতি প্রয়োজন রয়েছে শোনা এবং একে অন্যকে শোনার। আমাদের শুনতে হবে ঈশ্বরের শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে এবং তাঁর কন্ঠদিয়ে কথা বলতে হবে। “অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আমাদের প্রথম করণীয় হলো তাদের “শ্রবণ” করা। যে ব্যক্তি তার ভাই-বোনকে শুনতে শিখেনি, অচিরেই সে ঈশ্বরকে না শোনার সামর্থ অর্জন করবে।” সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পালকীয় কর্মকান্ড হলো “শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রৈরিতিক কাজ।” বলার আগে শুনতে হবে- যেমনটি বলেছেন সাধু যাকব তাঁর ধর্মপত্রে, “শুনতে সবাই আগ্রহী থাকুক (১:১৯)।” স্বাধীন ইচ্ছায় অন্যকে শোনার জন্য কিছু সময় বরাদ্দ করা হলো ভালোবাসার প্রথম কাজ।
১০. সংলাপ করা : একটি সঙ্গীতদলে ভিন্ন ভিন্ন কন্ঠ একসঙ্গে মিলে তৈরি হয় বহু কন্ঠনির্ভর একটি গীত। একই সময়ে, সঙ্গীতদলের প্রতিটি কন্ঠ অন্য কন্ঠগুলোর সঙ্গে মিল থেকে একটা পুরো সমন্বিত সঙ্গীত হয়ে ওঠে। সুরের এই ঐক্যতান তৈরি হয়ে সমন্বিত সঙ্গীত হয়ে ওঠে প্রত্যেকের ও সবার আলাদা আলাদা কন্ঠ-সুরে। এই উপলব্ধিটা আমলে নিয়ে আমরা নিজেদের জড়িত করবো অংশগ্রহণে যেনো আমরা পুন:আবিষ্কার করতে পারি সমন্বিত খ্রিস্ট-মণ্ডলি, যেখানে সবাই নিজ নিজ ও ভিন্ন ভিন্ন কন্ঠে গাইতে পারেন এবং একে অন্যের কন্ঠধ্বনিকে একটি দান হিসেবে স্বাগত জানিয়ে পবিত্র-আত্মার তৈরি সুরে- হয়ে ওঠতে পারে একটা সমবেত-সমন্বিত সঙ্গীত।
১১. ক্লান্ত না হও : পোপ ফ্রান্সিস বলছেন, তোমরা যেনো কোনো কিছু করতে ক্লান্ত না হও। অন্যের কল্যাণ করতে যেনো ক্লান্ত না হও, প্রার্থনা করতে যেনো ক্লান্ত না হও, মন্দ শেকড় উৎপাটন করতে ক্লান্ত না হও, প্রতিবেশীর প্রতি সক্রিয় উদারতা নিয়ে ভালো কাজ করতে ক্লান্ত না হও।
১২. যুব সমাজ হলো সমাজের লাইট লাইফ : অর্থ হলো আলোর জীবন/ আলোকিত জীবন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে পোলান্ড দেশের যুবকরা একটা সংগঠন তৈরি করেছিলেন- যার নাম ছিলো লাইট লাইফ। সে দেশের যুবগোষ্ঠী বছরে দুই সপ্তাহের জন্য একসঙ্গে ক্যাম্প করতো। এই ধারণা থেকেই গড়ে উঠেছে আজকের বিশ্ব যুব দিবস।
১৩. বিশ্ব যুব জয়ন্তী : ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ ছিলো ঘোষিত মুক্তির পূণ্যবর্ষ। এই বর্ষের সমাপ্তিপর্বে, পোপ ২য় জন পৌলের আহ্বানে গোটা বিশ্ব থেকে তিন লাখ যুবক ভাটিকানে সাধু পিতর মহামন্দির চত্বরে সমবেত হয়েছিলেন- সেটাই ছিলো প্রথম বিশ্ব যুব জয়ন্তী। পোপ বিশ্ব যুব দিবসের ঘোষণা দেন ২০ ডিসেম্বর, ১৯৮৫ এবং প্রথম বিশ্ব যুবদিবস পালিত হয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে রোম নগরীতে। আর মূল বিষয় ছিলো, “বরং তোমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রভুর, অর্থাৎ, খ্রিস্টের জন্যে পেতে রাখ শ্রদ্ধার আসন। অন্তরে তোমরা যে আশা লালন করছো, সেই আশার ভিত্তিটা কি, যখন যে কেউ তা জানতে চাক না কেনো, তোমরা তার উত্তর দিতে সর্বদাই প্রস্তুত থেকো। তবে উত্তর দিয়ো সবিনয়ে, সমুচিত সম্মান দেখিয়ে (১ পিতর ৩:১৫)।”
১৪. পানামা সিটি বিশ্ব যুব সম্মেলন : ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বশেষ বিশ্ব যুব সম্মেলন হয়েছিলো পানামা সিটিতে। আর মূলভাব ছিলো, মারীয়া তখন বললেন, “আমি প্রভুর দাসী! আপনি যা বলছেন, আমার তা-ই হোক (লুক১:৩৮)।”
১৫. লিসবন বিশ্ব যুব সম্মেলন ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ : চলতি বছর আগস্ট মাসের ১-৬ তারিখে পর্তুগাল দেশের রাজধানী লিসবন শহরে অনুষ্ঠিত হবে ১৬তম বিশ্ব যুব সম্মেলন। মূলভাব বেছে নেওয়া হয়েছে, “মারীয়া এবার বাড়ি ছেড়ে পার্বত্য অঞ্চলে যুদা প্রদেশের একটি শহরের দিকে তাড়াতাড়ি হেঁটে চললেন (লুক ১:৩৯)।” বিশ্ব যুব দিবসের জন্য প্রার্থনা- লিসবন শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্ব যুব দিবস যেনো তাদের জীবনকে মঙ্গলবাণীর সাক্ষ্য বহন করতে উৎসাহিত করে।
উপসংহার : সুতরাং যুব সমাজ সিনোডাল চার্চের সঙ্গে একত্রে যাত্রা করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে সিনোডাল চার্চের অর্থ হলো- মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ এবং শ্রবণ ও সংলাপের মাধ্যমে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে পবিত্র-আত্মার দ্বারা পরিচালিত হওয়া।