গত ২৮-৩১ আগস্ট, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে, ঢাকা’র সিবিসিবিতে “উন্মুক্ত হৃদয়ে মণ্ডলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ” মূলসুরের উপর ভিত্তি করে জাতীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের ৮টি ধর্মপ্রদেশ থেকে ১ জন বিশপ, ১০ জন ফাদার, ১১ জন সিস্টার এবং ৬০ জন খ্রিস্টভক্ত অংশগ্রহণ করেন।
বিকাল ৪ঃ০০ টার সময় আগমন ও রেজিস্ট্রেশনের ও সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিটে সান্ধ্যকালীন প্রার্থনার মধ্য দিয়ে কর্মশালার যাত্রা শুরু হয়। ৮:৩০ মিনিটে সকল অংশগ্রহণকারীগণ হল ঘরে সমবেত হলে আসন গ্রহণের পর উদ্বোধন প্রার্থনা, বাইবেল পাঠ এবং মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করার মধ্য দিয়ে কর্মশালার যাত্রা শুরু হয়। অত:পর নাচ, গান ও ফুল দিয়ে সকল অংশগ্রহণকারীদেরকে বরণ করে নেওয়া হয়।
সেমিনারের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন ফাদার আলবিন গমেজ, পরিচালক সিসিপি ডেস্ক। তিনি তার বক্তব্যে লেইটি কমিশনের চেয়ারম্যান বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ, ফাদার, সিস্টার ও দূরদুরান্ত থেকে আগত উপস্থিত সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আমাদের ২টি ডেস্ক রয়েছে একটি হলো সিসিপি অন্যটি হলো উইমেন ডেস্ক। আমরা যে মূলভাব নিয়েছি, এই বিষয়ে মণ্ডলিও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কিভাবে হৃদয়-মনে ও মণ্ডলিতে প্রসারিত করতে পারি। সিসিপি টিমের কাজ হলো ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ সক্রিয়করণ ও অংশগ্রহণকারী মণ্ডলি গঠন করা। বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ এই বিষয়গুলো গভীরভাবে সম্পৃক্ত করেন। মিলন অংশগ্রহণ ও ঐশবাণীর আলোকে মানুষের জীবন-যাপনে জোর দেওয়া হচ্ছে; যেন জীবন্ত ঐশবাণী সব মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারি। আমরা যেন সিনোডাল ও অংশগ্রহণকারী মণ্ডলি হয়ে উঠতে পারি। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয় মন প্রসারিত করতে হবে। ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে সকলে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং পবিত্র আত্মার কণ্ঠসর শুনতে পারে।
অত:পর ধর্মপ্রদেশভিত্তিক পরিচয় প্রদান করেন কর্মশালায় সকল অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যদিয়ে ১ম দিনের কার্যক্রম শেষ হয়।
২য় দিনের সকাল ৬:৩০ মিনিটে পবিত্র খ্রিস্টযাগের মধ্যদিয়ে দিনের কার্যক্রম শুরু করা হয়। পবিত্র খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ। সহার্পিত খ্রিস্টযাগে উপস্থিত ছিলেন ফাদার আলবিন গমেজ, ফাদার শিশির নাতালে গ্রেগরী, ফাদার বাবলু কোড়াইয়া, ফাদার কল্লোল রোজারিও, ফাদার ভিনসেন্ট মন্ডল, ফাদার তরুন বনোয়ারী, ফাদার চঞ্চল পেরেরা, ফাদার স্ট্যানিসলাউস গমেজ,ফাদার আনসেলমো মার্ডী ও সিস্টারগণ এবং অংশগ্রহণকারী খ্রিস্টভক্তগণ।
ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ বিষয়ক জাতীয় প্রশিক্ষণের মূল বক্তা এবং খ্রিস্টভক্তজনগণ বিষয়ক কমিশনের সভাপতি পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ কর্মশালার মূল বিষয় ‘উন্মুক্ত হৃদয়ে মণ্ডলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ’ -এর উপর উদ্বোধনী বক্তব্যে সবাইকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমাদের নিজেদের অন্তর প্রথমে অলোকিত ও প্রজ্জ্বলিত করতে হবে। এই জন্য আমাদের হৃদয়কে উন্মুক্ত করতে হবে। শিষ্যরা যিশুর সঙ্গে পথ চলেছেন, হেঁটেছেন এবং এক সাথে পথ চলার পরও মুক্তির কাজ সাধন করেছেন। কিন্তু নিজের জীবন দেওয়ার সময় কেউ তার পাশে ছিলেন না। যিশু এত কষ্ট ও ত্যাগস্বীকার করেছেন। তার ফলে সেই শিক্ষায় তাদের অন্তরে জ্বলে উঠেছে। সেজন্যই শিষ্যরা সারা জগতে যিশুর কথা প্রচার করেছেন। আমাদেরকে সেই জায়গায় আসা দরকার।
তিনি আরো বলেন, এবারের কর্মশালা যেন আমাদের সেই জায়গায় নিয়ে যায়। শিষ্যরা হৃদয়ে যে জ্ঞানে অভিজ্ঞতা করেছেন, সেইভাবে তা হৃদয়ে স্থান পায়নি। আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে বিশ্বাসের জন্য। শোভাযাত্রায় বাইবেল মোমবাতি নিয়ে একসাথে যাত্রা শুরু করেছি। এর মানে হলো কমুনিয়ন/মিলন। আমাদের জীবনের যাত্রার সময় যিশুকে সামনে রাখতে চাই। আমাদের সব সবকিছুতে যেন যিশু সামনে থাকেন। আমাদের সমস্ত কাজ তাকে সামনে রেখে করতে হবে। বাপ্তিস্মের মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছি। আমাদের কাজ সুনির্দিষ্ট করা আছে। বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে আমাদের অন্তরে প্রদীপ জ্বালাতে সক্ষম হবো।
এ ছাড়াও, তিন দিনের এ প্রশিক্ষণে আরো বেশ কয়েকজন ফাদার প্রশিক্ষণ দেন। তাদের মধ্যে ‘অংশগ্রহণকারী মণ্ডলির জন্য আমাদের স্বপ্ন’-এ বিষয়ের উপর ক্লাশ দেন ফাদার আলবিন গমেজ, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকর্মী – সাহায্যকারী নয়’- এ বিষয়ের উপর সহভাগিতা দেন ফাদার স্ট্যানিসলাউস গমেজ ও ফাদার আনসেলমো মার্ডী, ‘খ্রিস্টের প্রেরণকাজে অংশগ্রহণে আমরা প্রেরিত’-এ বিষয়ের উপর ক্লাস দেন ফাদার শিশির গ্রেগরী ও ফাদার বাবলু কোড়াইয়া এবং ‘নতুন ভাবধারার মণ্ডলিতে নেতৃত্ব উদ্দীপনাকারী মণ্ডলি’-এ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন ফাদার তরুন বনোয়ারী ও ফাদার ভিনসেন্ট মন্ডল।
এছাড়াও কর্মশালা চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন সময়ে সপ্তধাপ প্রার্থনা অনুশীলন করা হয়। এবারের কর্মশালায় ২য় দিবসে বিশেষ একটি দিক ছিল এক্সপোজার। হাসনাবাদ ধর্মপল্লীতে গিয়ে অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন গ্রামে ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজগুলোকে পরিদর্শন করে তাদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের ফাদার তপন মাইকেল ম্রং তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, নতুন সব কিছুর মধ্যেই নিজেকে সংযুক্ত করলে অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায়। মানুষ মাত্রই সুযোগ সন্ধ্যানী আমিও এর ব্যতিক্রম নই। “উন্মুক্ত হৃদয়ে মণ্ডলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ” এই মূলভাবের উপর ভিত্তি করে ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজের জাতীয় কর্মশালা ২০২৩ এ অংশগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। মাতামণ্ডলিতে ঐশজনগণের আরো সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং কীভাবে প্রাণবন্ত ও জীবন্ত ক’রে তোলা যায় সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের উপস্থাপনায় জানতে পেরেছি। ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ গঠনের দ্বারা বৃহত্তর কাথলিক মণ্ডলিকে আরো বেশী তরাণ্বিত করাই এই কর্মশালার মূললক্ষ্য। গঠনমূলক উপস্থাপনা এবং আলোচনার মাধ্যমে নিজেরা আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি এবং অন্যদের আলোকিত করার অনুপ্রেরণা লাভ করেছি। সমস্ত কিছুর জন্য ঈশ্বরকে এবং আয়োজক মণ্ডলিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।
চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশের অংশগ্রহণকারী মুক্তা বাড়ৈ একজন মহিলা প্রতিনিধি তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, সিবিসিবি সেন্টারে ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ, জাতীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে আমাদের মধ্যে কোন বৈষম্য না রেখে, সবাই যেন মিলে-মিশে খ্রিস্টান ভাই-বোন হিসেবে ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। এতে করে ঐশবাণী প্রচারে সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি।
দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের অংশগ্রহণকারী আন্না স্নিগ্ধা লাকড়া তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ জাতীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালা ২০২৩ এসে আমি খুবই আনন্দিত ও গর্বিত। তিন দিন ব্যাপী এ প্রোগ্রামে উন্মুক্ত হৃদয়ে মণ্ডলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ সম্পর্কে যুগোপযোগী জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি। আমি আমার নিজ ধর্মপ্রদেশে ও ধর্মপল্লীতে ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজকে এখন থেকে আরো বেশী সক্রিয় করতে তৎপর হব।
সমাপনী খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন সিসিপি ডেক্সের পরিচালক, ফাদার আলবিন গমেজ। তিনি সকল অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ দেন এবং উৎসাহিত করেন যেন এই ক্ষদ্র খ্রিস্টীয় সমাজের কাজ নিজ নিজ এলাকায় সুন্দর ভাবে চলমান রাখেন।
পরিশেষে এ প্রশিক্ষণে যারা বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন তাদের সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে শেষ করেন।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার: ফাদার বাবলু কোড়াইয়া