ফাদার সুনীল রোজারিও । বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক

এই বিষয়টি নিয়ে আগেও লিখেছিলাম। বিষয়টি নিয়ে দেশের বড় বড় পত্রিকায় আরো অনেকে লিখেছেন, এখনো লিখছেন। প্রশাসনও কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ নিমূর্লের জন্য কাজ করছেন। বাংলাদেশে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের শিশু আইন অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সীরা যখন কোনো অপরাধ করে তখন তাকে বলা হয় কিশোর অপরাধ। তবে কিশোর গ্যাংয়ের যারা মাস্টারমাইন্ড তাদের বয়স কিন্তু ১৮ বছরের বেশি। কিশোর অপরাধ এবং কিশোর গ্যাং বাংলাদেশের একটি নতুন সংষ্কৃতি। আগে কিছু ছিলো কিন্তু সেগুলো শিশুসুলভ আচরণ হিসেবেই দেখা হতো। “নাইন ষ্টার” কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তাদের বিরুদ্ধ সংগঠন “ডিস্কো বয়েজ”এর এক সদস্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করার পর, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে রাজধানীতে কিশোর গ্যাংদের ক্রিয়াকলাপ প্রশাসনের নজরে আসে। সে সময়ের বিভিন্ন তথ্য মতে, কমপক্ষে ১০ হাজারের মতো কিশোর-কিশোরী ৫০টির মতো কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলো। এই গ্যাংগুলোর নামও ছিলোও বিচিত্র। যেমন- নাইন ষ্টার, ডিস্কো বয়েজ, বিগ বস্, পাওয়ার বয়েজ, বিছ্ছু বাহিনী, ডন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ব্ল্যাক কোবরা, ডার্ক শ্যাডো, নাফিজ ডন, ইত্যাদি। নামগুলোই বলে দেয়- কিশোর গ্যাংগুলোর চরিত্র কেমন হতে পারে।

ইদানিং কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ বাংলাদেশে প্রশাসনের জন্য মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। প্রায়ই খবরের শিরোনাম হচ্ছে কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ। প্রথমে দেখলে মনে হয় এরা সব ছাত্র-ছাত্রী- একসঙ্গে মেলামেশা করছে। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, এদের আচরণ, চলাফেরা সাধারণ কিশোরদের মতো নয়। এরা নিজেদের খরচ বহন করার জন্য এলাকা থেকে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহ করে। দলের বড়রা, অপেক্ষাকৃত তরুণদের মাধ্যমে মাদক সরবরাহের কাজ করে এবং নিজেরাও মাদক গ্রহণ করে। বয়সে তরুণ বলে এরা প্রশাসনের নজরে আসে না। চোরাচালান, ইভটিজিং, যৌন হয়রাণী, খুন-সংঘর্ষ, ইত্যাদি, কিশোর গ্যাংদের কাজ। সমাজে বড়দের প্রতি তাদের স্বভাব ড্যাম কেয়ার। কিছু গ্যাং আবার “বড় ভাই” ও দাগি সন্ত্রাসীদের নির্দেশ মেনে কাজ করে থাকে। কিশোর গ্যাংরা তাদের অবৈধ কাজ ও সন্ত্রাসকে একটা হিরোইজম বা বাহাদুরি হিসেবে দেখে। প্রায় সবাই কোনো না কোনো ধরণের মাদক ও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।

গত ১৮ মে, “প্রথম আলো” পত্রিকা তার প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম করেছে, “বেপরোয়া ২৩৭ কিশোর গ্যাং।” পত্রিকায় বলা হয়েছে, “সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ২ হাজার ৩৭২জন। শুধু ঢাকা ও চট্রগ্রাম মহানগরেই কিশোর গ্যাং রয়েছে ১৮৪টি। কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টি কিশোর গ্যাং- সংশ্লিষ্ট।” কিশোর গ্যাং সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, “গ্যাংয়ের সদস্যরা কখনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবস্থান করে বা সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছিনতাই, চাঁদাবজি, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র ব্যবসা, পাড়া-মহল্লায় নারী ও কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করা এবং খুনের মতো অপরাধমূলক কর্মকান্ডে তারা জড়িয়ে পড়ছে।”

পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, “রাজনৈতিক শক্তি ও পরিচয় ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ব্যতীত কিশোর গ্যাং সমস্যার সমাধান হবে না।” মন্ত্রিসভার গত ৮ এপ্রিলের বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রি কিশোর গ্যাং মোকাবেলার জন্য কিছু ভিন্ন মাত্রার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “প্রথাগত অন্য অপরাধীদের সঙ্গে যেনো তাদের (কিশোর অপরাধী) মিলিয়ে ফেলা না হয়। তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সিলের ব্যবস্থা, কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা।” প্রধানমন্ত্রি আরোও বলেছেন, “তাদের যেনো দীর্ঘ মেয়াদে অপরাধী বানিয়ে ফেলা না হয়, সংশোধনের সুযোগ যেনো থাকে। কারাগারে অন্য আসামিদের সঙ্গে যেনো না রাখা হয়।” শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিশোর অপরাধ দমন সম্পর্কে ভূমিকা পালন করতে পারে। অভিভাবকদেরও এই বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।

কিশোর গ্যাং হয়ে ওঠার পিছনে কারণ কী ? সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং অপরাধতত্ত¡বিদদের মতে, পরিবার, সমাজ এবং রাজনীতি এর পিছনে দায়ী। পরিবারে বাবা-মা যেমন, সন্তান হবে তেমন, এটা চিরন্তন সত্য। পারিবারিক অশান্তি সন্তানদের বিপথে ঠেলে দেয়। ঝগড়া-বিবাদ ও বিচ্ছেদ শিশুদের মনে দারুণভাবে দাগ কাটে। তখন তারা বিকল্প কিছুর মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ত¡ খুঁজে। দ্রুত উন্নয়নশীল বিশ্বে এখন সময়ের বড় অভাব। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের নজর দেওয়ার সময় থাকে না। আবার দুর্বল সমাজ ব্যবস্থাও দায়ী। আদি অর্থে সমাজ বলতে এখন আর তেমন কিছু বাকী নেই। প্রাচীনকালে এলাকার কিছু পরিবার নিয়ে একটা কমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠতো। এখন নেই- সবাই যার যার মতো করে চলে। শাসন করার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই। কার সন্তান বয়ে গেলো, এই নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই। অন্যদিকে কিশোর অপরাধের পিছনে মিডিয়ার একটা ভ‚মিকা রয়েছে। টিভি সিরিয়ালগুলোতে যেভাবে ক্রাইম রিপোর্ট তুলে ধরা হয়- সেগুলো তরুণ মনে দাগ কাটে। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দেখে সেগুলোর বিরুদ্ধে তাদের এগিয়ে আসার বয়স হয়নি। উল্টো তা থেকে অবৈধ টেকনিকগুলো শিখে নেয়। ইদানিং সমাজমাধ্যমে যেসব উল্টা পাল্টা রিল প্রচার করা হচ্ছে, সেগুলোর ভাষা, বড়দের সঙ্গে ছোটোদের সম্পর্ক, উদ্ভট আচরণ সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না। এগুলো মার্জিত হতে হবে। মোটকথা, কিশোর অপরাধ দমনে পরিবার, সমাজ এবং প্রশাসনকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

আজকাল খ্রিস্টান সন্তানদের মধ্যেও অস্থির প্রবণতা বাড়ছে। ধর্মের প্রতি অনীহা, পড়ালেখায় অনিয়ম, মাদকদ্রব্য সেবন, পালিয়ে যাওয়া, কেলেঙ্কারি, এমনকী আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। পরিবারের অনেক অভিভাবক পেশাগত কারণে বাইরে থাকেন। ফলে সন্তানদের দেখার কেউ নেই। অনেককে দল বেধে রাস্তার মোড়ে, ব্রীজের উপর, প্রতিষ্ঠানের বাইরে মোবাইল হাতে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়। আবার এক সময় উধাও হয়ে যায়। এগুলো ভালো লক্ষণ নয়। কিছু অবৈধ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কথাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। সমাজের নেতা ও বিধায়কদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। স্থানীয় চার্চের পালকীয় পরিকল্পনার মধ্যে বিষয়টি অর্ন্তভ‚ক্ত করতে হবে। সবশেষে বলতে হয়- পরিবারে স্বচ্ছলতা, প্রতিপত্তি যতোই থাকুক, সন্তান নষ্ট হয়ে গেলে- অভিভাবকদের জন্য হবে নরক যন্ত্রণা। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

 

Please follow and like us: