রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপালের পালকীয় পত্র ২০২৪
খ্রিস্টেতে প্রিয় ভাইবোনেরা,
বিগত ২ বছর আমরা সিনোডাল বা মিলনধর্মী মণ্ডলির বিষয় নিয়ে ধ্যান প্রার্থনা করেছি, আলোচনা করেছি এবং সকলে মিলে মণ্ডলিতে একত্রে পথ চলার অঙ্গীকার করেছি ও তা বাস্তবায়নের পথ খুঁজেছি। আমরা সিনোডাল মণ্ডলিতে খ্রিস্টবিশ্বাসীদের মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণের দায়িত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি আর সেই দায়িত্ব আমরা কিভাবে পালন করতে পারি সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেছি। আমরা কতটুকু সফল হয়েছি তা আমরা নিজেরাই অনুধাবন করতে পারছি। তবে এই কথা ঠিক আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে এই সিনোডাল মণ্ডলির বাস্তবায়নের পথে।
মিলনের জন্য দরকার ‘অন্তর্ভুক্তি’ ও ‘সংলাপ’ যা আমাদের অন্তরেই জন্ম নেয়। আমাদের সদিচ্ছা ছাড়া এই মিলনের যাত্রা সম্ভব নয় – আর সদিচ্ছাই আমাদের উদ্বুদ্ধ করে যেন আমাদের অন্তরে আমরা প্রতিবেশী ভাইবোনদের ও প্রতিবেশকে স্থান দিতে পারি এবং তাদের সাথে সংলাপ গড়ে তুলতে পারি। তবে এটা সত্য যে মানব সমাজে আমরা এখনো মিলন, শান্তি ও সংহতি গড়তে পারিনি। চারিদিকে দন্দ্ব-বিবাদ, ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য, অন্যায্যতা ও অশান্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং প্রকৃতির প্রতি মানুষের বৈরী আচরণ পৃথিবীকে করে তুলেছে সংঘাতময় ও নিরাপত্তাহীন আবাসগৃহ; ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই পৃথিবী ক্রমেই হয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত অভিযাত্রা। ঈশ্বরের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে ও প্রকৃতির সঙ্গে একক ব্যক্তি বা মানব সমাজ হিসেবে আমাদের সম্পর্ক হয়ে পড়ছে নিম্নমুখী। মানব সমাজে আমরা স্বার্থপরভাবে অন্যকে বাদ দিয়ে শুধু নিজে স্বার্থ হাসিলের জন্য যা করা উচিত নয় আমরা তাই করে যাচ্ছি। অথচ আমরা জানি আমরা নিজেরা যতই চেষ্টা করি না কেন আমরা ঐসব কিছুতে সার্থকতা বা শান্তি লাভ করতে পারি না। সামসঙ্গীতে যেমন বলা হয়েছে, “ঈশ্বর নিজেই যদি গৃহটি না নির্মাণ করেন, বৃথাই হয় নির্মাণকর্মীদের এত পরিশ্রম” (সাম ১২৭:১)। আমরা আমাদের নিজেদের শক্তিতে কিছুই করতে পারব না, যদি ঈশ্বর আমাদের সাহায্য না করেন। তাই আমাদের জীবনে ও কাজে, সকল কিছুতেই ঈশ্বরের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মেনে চলব যেন আমরা সফল হতে পারি – আমাদের আত্মায় বেড়ে উঠতে পারি।
অন্তর্ভুক্তি (Inclusivity) ও সংহতি (Solidarity) ছাড়া প্রেমপূর্ণ মিলন সমাজ গড়া সম্ভব নয়। অন্তর্ভুক্তি মানে হলো সকলকে সঙ্গে রাখা বা অন্তরে স্থান দেওয়া; কাউকে বাদ না দিয়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলা বা জীবন যাপন করা। আর সংহতি অর্থ অন্যের সাথে এক হওয়া বা একাত্ম হওয়া; প্রতিবেশী ভাইবোনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়া। স্বার্থপরতা ও অহংকার আমাদেরকে ঈশ্বর ও প্রতিবেশী ভাই-বোনদের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে ঈশ্বর আমাদের সকলকে সমান ভালবাসা দিয়ে সমান করেই সৃষ্টি করেছেন। তিনি চান যেন আমরা আমাদের প্রতিবেশী ভাইবোনদের ও তাঁর সৃষ্টিকে ভালবেসেই তাঁর প্রতি আমাদের ভালবাসা প্রকাশ করি। ঈশ্বরকে ছাড়া যেমন আমরা কিছুই করতে পারি না; তেমনি প্রতিবেশী ভাইবোনদের সহায়তা ছাড়াও আমরা জীবন যাপন করে পারি না।
আদম ও হবার প্রধান পাপ ছিল যে তারা নিজেদের বুদ্ধিতে ও চেষ্টায় স্বর্গে যেতে চেয়েছিল; তাই তারা ঈশ্বরের কথা শোনেনি ও তাঁর নির্দেশ মানেনি। তাদের পাপ তাদের জন্য নিয়ে এসেছে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা; তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে, নিজেদের কাছ থেকে, অন্য মানুষদের কাছ থেকে ও প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আর ঈশ্বর-বিহীন মানুষদের কি অবস্থা হয়, আমরা তা বাবেলের ঘটনায় তা প্রত্যক্ষ করতে পারি (আদি ১১:১-৯)। পক্ষান্তরে আমরা পঞ্চাশত্তমীর ঘটনায় দেখতে পাই পবিত্র আত্মা খ্রিস্টবিশ্বাসীদের এক করে তুলেছে। প্রেরিতদূতদের উপদেশ বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষেরা নিজেদের ভাষায় শুনেছিল ও বুঝেছিল (প্রেরিত ২:১-৪১)। তাই পবিত্র আত্মাই হচ্ছেন একতা বা একাত্মতার উৎস ও কারিগর। পবিত্র আত্মাকে বাদ দিয়ে আমরা কখনোই মিলন সমাজ গড়তে সক্ষম হতে পারব না।
কাথলিক মণ্ডলির ধর্মশিক্ষা বইয়ে লেখা আছে: “খ্রিস্টের আশ্রয়ে মণ্ডলি একটি সংস্কার বা সাক্রামেন্তস্বরূপ, অর্থাৎ পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলন ও সমস্ত মানুষের মধ্যে একতার চিহ্ন ও উপায়স্বরূপ খ্রিস্টমণ্ডলির সঙ্গে তার সেই মিলন, সেহেতু খ্রিস্টমণ্ডলি মানবজাতির মধ্যে একতারও সংস্কার। তার মধ্যে এই একতা ইতোমধ্যেই সূচিত হয়েছে, কারণ প্রতিটি জাতি, গোষ্ঠি, দেশ ও ভাষার মানুষকে সে ইতোমধ্যে সমবেত করতে শুরু করেছে। একই সময়ে মণ্ডলি হলো ভাবী একতার পূর্ণ বাস্তবায়নের চিহ্ন ও উপায়” (কাথলিক মণ্ডলির ধর্মশিক্ষা-৭৭৫)।
মিলন বা Communion কথাটি এসেছে লাটিন শব্দ Communio থেকে, গ্রীক ভাষায় যার অর্থ Koinonia অর্থাৎ যারা একটি দেয়াল ঘেরা স্থানে বা একটি নির্দ্দিষ্ট ভৌগলিক স্থানে পারস্পরিক কলাণের উদ্দেশে বসবাস করে। এই অর্থেই মণ্ডলি একটি সংস্কারীয় বা কল্যাণকারী সমাজ বা সামাজিক সংস্কার। নতুন নিয়মে সাধু পল মণ্ডলিকে তুলনা করেছেন খ্রিস্টের দেহরূপে। তাঁর মতে ‘কইনোনিয়া’ হলো সেই সব মানুষের সমাজ যারা একই প্রকার বাস্তবতা বা অবস্থার মধ্যে বসবাস করে (১ করি ১০:১৫-১৭; ১২: ১২, ২৬-২৭)। তবে মাণ্ডলিক ‘কমুনিয়ন’ কোন সামাজিক বা গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর নয় বরং ঐশতাত্তি¡ক ভিত্তির উপর স্থাপিত। এর ফলে মণ্ডলির প্রতিটি সদস্য খ্রিস্টদেহ গ্রহণ করে অর্থাৎ খ্রিস্টের জীবনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সেই দেহের অংশী হয়ে ওঠে যার মস্তক হলেন স্বয়ং খ্রিস্ট। সেই দেহের চালিকাশক্তি হলো ‘পবিত্র আত্মা’। মণ্ডলিতে এই মিলন পূর্ণভাবে রূপায়িত হয় পবিত্র খ্রিস্টযাগে বা রুটিভাঙ্গার অনুষ্ঠানে। খ্রিস্টপ্রসাদের পুণ্যভোজ গ্রহণ করে যাজক ও খ্রিস্টবিশ্বাসীরা হয়ে ওঠে ‘এক রুটি ও এক দেহ’ – সেই জীবন্ত দেহ যার মস্তক স্বয়ং খ্রিস্ট।
কিন্তু আমরা জানি যে জাগতিক বাস্তবতা হলো, আমরা আমাদের জীবন বা পরিচয় থেকে অন্যদের বাদ দিতে চেষ্টা করি। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ভৌগলিক স্থান, বিদ্যাপীঠ, চামড়ার রং, ধর্ম, বর্ণ, ইত্যাদি অনেক কারণে আমরা মানব সমাজে বিভেদ ও বৈষম্য দেখতে পাই। বিভিন্ন স্থানের মণ্ডলিতেও এই বিভেদ ও বৈষম্য রয়েছে; রোমে অনুষ্ঠিত সিনোড সভার প্রতিবেদনেও এই বিষয়টি উঠে এসেছে। আমাদের ধর্মপ্রদেশও এই বিষয়টি থেকে মুক্ত নয়। তাছাড়া এখানে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য রয়েছে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতই। বাংলাদেশের সর্বত্রই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা অন্যদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য আচরণ করে। আমাদের মণ্ডলিতে বয়স ও লিঙ্গ নিয়েও বিভেদ ও বৈষম্য দেখা যায়। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা-সহভাগিতা ও আদান-প্রদান করার মত মনোভাবের অভাব রয়েছে। এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু সহজেই কিছু পরিবর্তন হয় না। অথচ আমরা সকলে একই ঈশ্বরের সৃষ্ট: “আমার সমস্ত সত্তা তেমারই রচনা; মাতৃগর্ভে তুমিই তো বুনে বুনে গড়েছ আমায়! এই আমি, এই যে সৃজন, কত না আশ্চর্য অপরূপ, সেই ভেবে আমি করি তোমারই বন্দনা” (সাম ১৩৯:১৩-১৪)। ঈশ্বরের কাছে আমরা সকলেই মহামূল্যবান; সকলেই আমরা সমান। খ্রিস্টসমাজে যিশুর শিক্ষা বাস্তবায়ন করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন বিকল্প নেই। আমাদের অবশ্যই সকল প্রকার বিভেদ ও বৈষম্য জয় করে অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে হবে। তবেই তা হবে সত্যিকারের খ্রিস্টদেহরূপ মণ্ডলি।
বিগত ২ বছরেরও অধিক সময় ধরে আমরা আমাদের ধর্মপ্রদেশকে একটি সিনোডাল মণ্ডলি হিসেবে গড়ে তোলার বিষয় নিয়ে অনেক আলাপ আলাচনা করেছি। গত বছর রোমে অনুষ্ঠিত বিশপগণের সিনোড থেকেও আমরা একটি দলিল পেয়েছি যা আমাদের সিনোড সংক্রান্ত অনুধ্যানকে আরও পরিষ্কার ও বেগবান করবে। একটি বিষয় সেখানে খুবই স্পষ্ট হয়েছে আর তা হলো: মণ্ডলি হবে অন্তর্ভূক্তিমূলক যেখানে সকলেরই স্থান রয়েছে; আর পবিত্র আত্মা সকলকে একই বন্ধনে আবদ্ধ করে এক দেহ করে তোলে। সামাজিক মিলন, অন্তর্ভূক্তি ও সংলাপের মধ্য দিয়ে আমরা সেই মাণ্ডলিক সমাজ স্থাপন করতে পারি। যিশু পিতার কাছে প্রার্থনা করেছেন যেন আমরা এক হতে পারি: “হে পিতা, আমরা যেমন এক তারাও সকলেই যেন এক হতে পারে….” (যোহন ১৭:২১-২৩)। সাধু পল করিন্থীয়দের কাছে পত্রে লিখেছেন: “আমাদের দেহ এক, অথচ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনেক, এবং দেহের অঙ্গগুলি অনেক হয়েও সবক’টি মিলে এক দেহই হয়। খ্রিস্টও ঠিক তেমনি! কারণ একই পবিত্র আত্মার শক্তিতে আমরা সকলেই দীক্ষাস্নাত হয়ে একই দেহের অঙ্গ হয়ে উঠেছি – তা আমরা ইহুদী বা অনিহুদী, ক্রীতদাস বা স্বাধীন মানুষ, যা-ই হই না কেন। এবং সেই একই আত্মার উৎস থেকে আমাদের সকলকেই পান করতে দেওয়া হয়েছে” (১ করি ১২:১২-১৩)।
মণ্ডলি প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে পরিবারের বিষয় উঠে আসে। পরিবার হলো গৃহমণ্ডলি, যেখানে স্বামী, স্ত্রী ও তাদের সন্তানরা মিলে একটি ক্ষুদ্র মিলন সমাজ গড়ে তোলে। সাধু বোনাভেঞ্চার বলেছেন বৃহৎ মণ্ডলি যেমন একটি মিলন সমাজ, তার ক্ষুদ্ররূপ হলো খ্রিস্টীয় পরিবার। পরিবারের সমস্যা মণ্ডলিকে সমস্যাগ্রস্ত করে তোলে। বর্তমানে আমাদের পরিবারগুলি বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল-অশান্তি, বৈবাহিক জীবনে অবিশ্বস্থতা, চাকুরীর কারণে একজন অন্যজনের কাছ থেকে দূরে অবস্থান করার কারণে বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার, ইত্যাদি অনেক পরিবারেই দেখা যায়। তাছাড়া মদ্যপান বা নেশা করা, অর্থনৈতিক অপরিনামদর্শিতা ও ঋণগ্রস্ততা, ভোগবাদ (consumerism) ও আপেক্ষিকতাবাদ (relativism), অশুভ প্রতিযোগিতা, অন্যের প্ররোচনা, ধৈর্য্য ও সহনশীলতার অভাব, ইত্যাদি কারণে পরিবারে অশান্তি-অমিল বেড়েই চলেছে। এইসব কারণে অনেক খ্রিস্টীয় পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। অনেক পরিবারের সন্তানরাও বিভিন্নভাবে সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে আর পরিবারে সমস্যা সৃষ্টি করছে। তাদের অনেকে মাদকাসক্ত হচ্ছে, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট আসক্ত হয়ে পড়ছে, লেখাপড়ায় অমনোযোগী হচ্ছে, পরিবারে নানা প্রকার বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টি করছে, ইত্যাদি। কিছু কিছু পরিবারে প্রবীণগণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ অবজ্ঞা ও অবহেলায় বসবাস করছে। এইসব কারণে পরিবারে মিলনের পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে। পরিবারে নারীর অধিকার ও মর্যাদায় ঘাটতি রয়েছে। এইসব সমস্যা এখনই দূর করা না গেলে ভবিষ্যতে পরিবারগুলি আরও বড় সমস্যায় পড়বে। তাই পরিবারগুলিতে আরও পালকীয় সেবা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। তবে এই পালকীয় সেবা কাজ শুধু যাজক বা ধর্মব্রতীদের নয়; এই কাজে পরিবারগুলিকেই সক্রিয় হতে হবে। পরিবারগুলিকে উন্মুক্ত হয়ে অন্য পরিবারকে সাহায্য করার মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের পরিবারে মিলন গড়ে তুলে তাদের হতে হবে “পরিবারের জন্য পরিবার”। সাধু পোপ জনপল তাঁর পারিবারিক মিলনবন্ধন নামক পত্রে বলেছেন, “পরিবার, তুমি যা তা-ই হয়ে ওঠ” (১৯৮১)। তাঁর মতে পরিবার হলো জীবন ও প্রেমের সমাজ – যা গোটা সমাজকেই রূপান্তরিত করতে পারে।
শুধু পরিবারই নয় আমাদের গোটা সমাজ ও সংস্কৃতিও এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপল্লীগুলিতে খ্রিস্টভক্তদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অনেক সমস্যা, অশান্তি ও অন্যায্যতা রয়েছে। যিশুর শিক্ষা পরিপন্থী অনেক আচরণ ও কর্মকান্ড সেখানে দেখা যায়। অনেক পরিবার দরিদ্রতার কারণে সন্তানদের যথাযথ শিক্ষা ও গঠন দিতে পারছে না। মাদকাসক্তি, অন্যায্যতা, অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, অশুভ প্রতিযোগিতা, সন্তানদের বখাটেপনা, ইত্যাদি কারণে সমাজে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। গ্রাম বা পাড়ায় সামাজিক মিলন ও সংহতি এখন খুব কম দেখা যায়। সমাজের নেতৃত্ব দূর্বল থাকায় সেখানে অনেক প্রকার বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। সামাজিক বিচার আচারে ন্যায্য বিচার হয় না; বরং বিভিন্নভাবে দুর্বলদের উপর নির্যাতন ও অন্যায়ভাবে দায় চাপানো হয়। পরিবারে যেমন সমাজেও তেমনি নারীকে যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া হয় না। পূর্বের ন্যায় এখন সমাজের লোকেরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও পারিবারিক মিলন মেলায় সমবেত হয় না। আর তা হলেও আগের মত আর সহভাগিতা, সহযোগিতা ও সামাজিক সংহতির আমেজ থাকে না। তাই সমাজে যেন পারস্পরিক ভালবাসা ও মিলনের আনন্দ গড়ে ওঠে সেইজন্য সমাজের নেতৃত্বকে খ্রিস্টীয় আদর্শে গড়ে তুলতে হবে। যিশু যেমন বলেছেন আমাদের সেই রকমই হতে হবে: “তোমরা পরস্পরকে ভালবাস। আমি যেমন তোমাদের ভালবেসেছি, তোমরাও তেমনি পরস্পরকে ভালবাস” (যোহন ১৩:৩৪)।
আমরা যে কোন সংস্কৃতির মানুষই হই না কেন আমাদের যিশুর শিক্ষা মেনে চলতে হবে। কোন সংস্কৃতি বা স্থানীয় আচার আচরণ যিশুর শিক্ষাকে অবজ্ঞা করতে পারে না। যদি স্থানীয় সংস্কৃতি বা রীতিনীতি যিশুর বা মণ্ডলির শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে তাহলে সেই সংস্কৃতি বা রীতিনীতি খ্রিস্টানরা পালন করতে পারে না। মঙ্গলসমাচার ও মণ্ডলির আইন খ্রিস্টানদের কাছে সকল আইনের উর্ধ্বে। এমনকি রাষ্ট্রও খ্রিস্টানদের মঙ্গলসমাচারের শিক্ষা অনুসরণ করতে বাধা দিতে পারে না। তাই আমরা চিন্তা করে দেখব কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক মিলনের জন্য বাধা সৃষ্টি করছি ও আমাদের অন্য ভাইবোনদের বিশ্বাসের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করছি। সেই সব বাধা যত শীঘ্র সম্ভব আমরা যেন অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করি। সাধু পল এফেসীয়দের কাছে লিখেছেন: “তোমাদের মধ্যে কোন তিক্ততা, কোন রোষ-আক্রোশ রেখো না; কোন কটু কথা, কোন ক্রুদ্ধ চিৎকার, কোন-রকম অনিষ্ট-কামনা, আর নয়। তোমরা একে অন্যের প্রতি সহৃদয় হও, হও কোমলপ্রাণ। পরস্পরকে তোমরা ক্ষমা করে নাও, যেমন খ্রিস্টে তোমাদের আশ্রয় দিয়ে পরমেশ্বরও তোমাদের ক্ষমা করেছেন” (এফেসীয় ৪:৩১-৩২)। তাছাড়া প্রভুর প্রার্থনায় বলি, ‘আমরা যেমন অপরাধীকে ক্ষমা করি তেমনি তুমিও আমাদের ক্ষমা কর’ (মথি ৬:৯-১৩)। ক্ষমা না করলে আমরা সামাজিক মিলন কখনোই আশা করতে পারব না।
আমাদের ধর্মপ্রদেশের ধর্মপল্লীগুলিতে অনেক সুন্দর বা ভাল কাজ হচ্ছে; কিন্তু দুঃখের বিষয় সেখানে সর্বত্র বা সর্বদা মিলনের চিত্র দেখা যায় না। সেখানে অনেক সময় বা অনেকবার হিংসা, রেষারেষি, বিবাদ-বিম্বাদ, অমিল, পরস্পরকে দোষাদোষি ও অসহযোগিতার পরিবেশ দেখা যায়। সাধু যোহন তাঁর ১ম পত্রে বলেছেন: “প্রীতিভাজনেরা, এসো আমরা পরস্পরকে ভালবাসি, কারণ ভালবাসা ঈশ্বরের কাছ থেকেই আসে। যে-কেউ ভালবাসে সে পরমেশ্বরের সন্তান, সে পরমেশ^রকে জানে। ভাল যে বাসে না সে পরমেশ্বরকে জানে না, কারণ পরমেশ্বর যে প্রেমস্বরূপ। আমাদের প্রতি পরমেশ্বরের ভালবাসা এতেই প্রকাশিত হয়েছে যে, তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে এই জগতে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তাঁর দ্বারাই আমরা জীবন লাভ করি” ( যোহন ৪:৭-৯)। সেই জীবন হল খ্রিস্ট-প্রেমের জীবন। তাই আমরা প্রতিদান পাবার আশায় যেন কোন ভালাবাসা বা পরোপকারের কাজ না করি। “কোন ভোজ সভার আয়োজন করলে … যত গরিব, পঙ্গু, খোঁড়া আর অন্ধ লোকদেরই নিমন্ত্রণ কর। তাহলে ধন্যই হবে তুমি, কারণ প্রতিদান দেবার মত সামর্থ্য তাদের যে নেই” (লুক ১৪:১৩-১৪)। আমাদের ধর্মপল্লীগুলিতে যেন সেই রকম পরিবেশ বিরাজ করে। ধর্মপল্লী হবে অন্তর্ভূক্তিমূলক; এটা সকলেরই আশ্রয়স্থল।
তাছাড়া আমাদের ধর্মপল্লীগুলিতে থাকতে হবে সংলাপের চর্চা, যা পারস্পরিক ভালবাসা প্রকাশেরই একটি মাধ্যম। সেখানে বড়-ছোট, ধনী-গরীব, মূলধারা-প্রান্তিক জনগোষ্ঠি, আদিবাসী-বাঙ্গালী, শিশু-যুবক-প্রবীন, ইত্যাদি সকলের মধ্যে থাকতে হবে সংলাপ ও সংহতি। এইভাবেই আমাদের ধর্মপল্লীগুলিতে যে বৈষম্য ও ভেদাভেদ রয়েছে তা দূর করতে হবে। সেখানে প্রতিটি গ্রামে বা ব্লকে সকলকে নিয়ে গড়তে হবে ‘ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ’, যে সমাজ হবে ভালবাসা ও আদান-প্রদানের একটি আদর্শ সমাজ। যিশুর শিক্ষা মত সেখানে যদি ভালবাসা থাকে “তাতেই তো সকলে বুঝতে পারবে, তোমরা আমার শিষ্য” (যোহন ১৩:৩৫)। এটাই হবে মণ্ডলি হওয়ার নতুন পথ কারণ আমরা যারা দীক্ষিত আমরা সকলেই হয়ে উঠেছি নতুন মানুষ। তাই মনে রাখতে হবে, আমরাই হলাম মণ্ডলি আর মণ্ডলি আমাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে। আমরা যদি মণ্ডলির জন্য আমাদের অবদান না রাখি তাহলে মণ্ডলিও আমাদের জন্য কিছু করতে পাবে না।
মণ্ডলিতে মিলন স্থাপনের দায়িত্ব সকল বিশ্বাসী ভক্তের। যাজক, সন্ন্যাসব্রতী ও খ্রিস্টভক্ত সকলেরই ভূমিকা রয়েছে সেখানে। সকলেই সেখানে মিলন সাধনা করবে, অংশগ্রহণ করবে ও প্রেরণকাজ করবে। মণ্ডলি হবে সম্পূর্ণরূপে ‘সিনোডাল’ বা মিলনধর্মী। আমাদের ধর্মপল্লীগুলির জন্য মডেল হলো আদি খ্রিস্টমণ্ডলি যেখানে “প্রেরিতদূতেরা যা কিছু উপদেশ দিতেন, সকলে তা নিষ্ঠার সঙ্গে শুনতো; তারা মিলে মিশেই জীবন যাপন করত এবং নিয়মিতভাবেই রুটিভাঙ্গার অনুষ্ঠানে যোগ দিত। … খ্রিস্টবিশ্বাসীরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ ছিল; তাদের সব কিছুই ছিল সকলের সম্পত্তি” (প্রেরিত ২:৪২)। তাদের মধ্যে যে সহভাগিতা ও সহযোগিতার জীবন ছিল তা হয়তো আমরা সব কিছুই অনুসরণ করতে পারব না। কিন্তু আমাদের মধ্যে যেন সেই মনোভাব থাকে আমরা সেই চেষ্টাই করব।
খ্রিস্টেতে প্রিয়জনেরা, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দটি হবে ‘খ্রিস্ট জুবিলি’র বছর। অর্থাৎ আমরা পালন করব খ্রিস্টজন্মের ২০২৫ বর্ষপূর্তির উৎব। সেই উপলক্ষে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস আমাদের প্রস্তুতিমূলক প্রার্থনা করতে বলেছেন। আমরা গভীর বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করব যেন আমরা আগামী বছর জুবিলী পালনের মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরের প্রচুর আশীর্বাদ লাভ করতে পারি। যিশু নিজেই আমাদের শিখিয়েছেন কেমন করে প্রার্থনা করতে হয় (মথি ৬:৯-১৩)। আর আমরা পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করব কারণ যিশু বলেছেন, “আমার নামে তোমরা যা কিছু চাইবে, তা তোমাদের দেওয়া হবে” (যোহন ১৪:১৩-১৪)। যিশু আরও বলেছেন, “তোমরা যদি বিশ্বাস কর, তাহলে তোমরা যা প্রার্থনা করবে, তা তোমাদের দেওয়া হবে” (মথি ২১:২২)। “তোমরা চাও তোমাদের দেওয়া হবে, খোঁজ কর তোমরা খুঁজে পাবে, দরজায় ঘা দাও তোমাদের জন্য দরজাটি খুলে দেওয়া হবে” (মথি ৭:৭)। এই বছর আমরা পুণ্যপিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রার্থনা করব ‘আশার তীর্থযাত্রী’ হয়ে। আমরা প্রার্থনা করব যেন আমাদের মিলনের আশা পূর্ণ হয়: আমরা যেন মিলতে পারি ঈশ্বরের সঙ্গে আর আমাদের সকল ভাইবোনের সঙ্গে। যিশু বলেছেন, “যেখানে দুই বা তিনজন একত্রে আমার নামে মিলিত হয় সেখানে তাদের মাঝখানে আমি আছি” (মথি ১৮:১৯-২০)। ধর্মপল্লীতে খ্রিস্টযাগ ও সংস্কারীয় অনুষ্ঠানসমূহ খ্রিস্টভক্তদের মধ্যে মিলন সৃষ্টি করে; আর রোজারিমালা প্রার্থনা পরিবারের সদস্যদের এক করে তোলে। ‘যে পরিবার একত্রে প্রার্থনা করে, সেই পরিবার সর্বদা একত্রে থাকে’। শুধু এই পৃথিবীতে নয়, আমরা মিলিত হব স্বর্গরাজ্যে। আসুন তাই আমরা মিলন সাধনা করি – আমাদের পরিবারে, সমাজে ও ধর্মপল্লীতে ভাইবোনদের সঙ্গে অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সংহতিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলি।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ