ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও
রূপকল্প :– মিলন সাধনা : অর্ন্তভূক্তি ও সংহতি; সিনোডাল বা মিলনধর্মী মণ্ডলি- যা ভক্তদের মধ্যে গড়ে তোলে মিলন; অংশগ্রহণ ও প্রেরণ দায়িত্বের মধ্যদিয়ে একত্রে পথ চলার অঙ্গীকার। মণ্ডলি- পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলন ও মানব সমাজের মধ্যে একতার চিহ্ন। পরিবার-গৃহমÐলি; খ্রিস্টীয় আদর্শে সামাজিক নেতৃত্ব; সংস্কৃতি; সংলাপ চর্চা; খ্রিস্ট জুবিলি- আশার তীর্থযাত্রা। এসব মিলেমিশে একাত্ম হয়ে- হয়ে উঠতে পারে, “একত্রে পথ চলা” ও একটি “আদর্শ খ্রিস্ট মণ্ডলি।”
পর্যালোচনা :- সামগ্রিকভাবে একটি সফল মণ্ডলি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে উপরে উল্লেখিত রসদগুলো বিশপ তাঁর পালকীয় পত্রে ব্যাখ্যাদানের চেষ্টা করেছেন। পত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে “মিলন সাধনা।” মানুষের পক্ষে কোন কিছু অর্জন সম্ভব নয় “সাধনা” ছাড়া। সাধনা হলো একটু একটু অনুশীলন ক’রে নিজের মধ্যে লক্ষ্যটা পুরো মাত্রায় অর্ন্তভূক্ত করা। মিলন সাধনা যখন নিজের মধ্যে অর্ন্তভূক্ত হয়- তখন তাঁর মধ্যে আবেদন জেগে ওঠে- অন্যকে তার অন্তরে স্থান দিয়ে অর্ন্তভূক্ত করা- যেমন ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি ক’রে সমানভাবে ভালোবেসে নিজের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত করেছেন। সুতরাং “অর্ন্তভূক্তি” হলো সব মানুষকে সমানভাবে ভালোবেসে পারস্পরিক সহায়তায় জীবন যাপন ও সৃষ্টির মধ্যে সর্বজনীন মিলন গড়ে তোলা।
অন্যদিকে “সংহতি” হলো- অন্যের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া, একাত্ম হয়ে যাওয়া, মিশে যাওয়া ও অন্যের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। এই একাত্ম হয়ে যাওয়া মানে প্রতিবেশীকে নিজের অন্তরে ধারণ ক’রে প্রাত্যহিক জীবনে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উৎসবের সহযাত্রী হয়ে মিলন-ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করা। আবার এই মিলন হলো একটি নিদির্ষ্ট স্থানে বসবাস ক’রে পারস্পরিক কল্যাণ সাধন করা। মানুষ সামাজিক- তাই সামাজিক দায়-দায়িত্ব নিয়ে মিলনের মধ্যদিয়ে বসবাস করতে হয়। ঈশ্বরবিহীন মানুষ যেমন দিক্ভ্রষ্ট হয়, তেমনি প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা-বিহীন মানুষ ঈশ্বরের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। মনে রাখতে হবে- ঈশ্বরকে লাভ করতে হলে আগে মানুষকে লাভ করতে হবে। ঈশ্বরের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, মানুষের মধ্যদিয়েই ঈশ্বরের কাছে গিয়ে পৌঁছে। সৃষ্টিকে ভালো না বেসে, স্রষ্টাকে ভালোবাসা যায় না।
বিশপ তাঁর পালকীয় পত্রের বিভিন্ন অংশে মানুষে মানুষে বিভেদ, বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশের সর্বত্রই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা অন্যদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য আচরণ করে।” এই বৈষম্য শুধু বৃহত্তর সমাজে নয়। তিনি বলেন, “বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধবোধ, সহযোগিতা-সহভাগিতা ও আদান-প্রদান করার মতো মনোভাবের অভাব রয়েছে।” সব বিভেদ-বৈষম্য ভুলে অর্ন্তভূক্তিমূলক সমাজ গড়ে উঠলে হবে- সত্যিকারের খ্রিস্টদেহরূপ মণ্ডলি।
“মণ্ডলি” সম্পর্কে পত্রে বলা হয়েছে- “মণ্ডলি হবে অর্ন্তভূক্তিমূলক, যেখানে সকলেরই স্থান রয়েছে।” এই মণ্ডলির প্রাণ হলো পবিত্র আত্মা। যে “পবিত্র আত্মা সকলকে একই বন্ধনে আবদ্ধ ক’রে একদেহ করে তোলে।” মণ্ডলির সবাই যেনো পবিত্র-আত্মার বন্ধনে এক থাকতে পারে সেই জন্য খ্রিস্ট পিতার কাছে প্রার্থনা করে বলেছেন, “হে পিতা, আমরা যেমন এক, তারাও সকলেই যেনো এক হতে পারে।” আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিলে যেমন একদেহ হয়ে ওঠে, তেমনি সব ভক্ত মিলে-মিশে, সব গৃহমণ্ডলি সহযাত্রী হয়ে গড়ে তোলে একটি খ্রিস্ট সমাজ, একটি পূর্ণ মণ্ডলি।
“গৃহমণ্ডলি পরিবার” হলো মণ্ডলির আলাদা আলাদা কোষ। পালকীয় পত্রে পরিবার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “পরিবার হলো গৃহমণ্ডলি, যেখানে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তান মিলে একটি ক্ষুদ্র মিলন সমাজ গড়ে তোলে।” অন্য কথায় “মণ্ডলিযেমন একটি মিলন সমাজ, তার ক্ষুদ্ররূপ হলো খ্রিস্টীয় পরিবার।” মণ্ডলিভক্ত বর্তমান পরিবারগুলোর বাস্তবতা লক্ষ্য ক’রে পালকীয় পত্রে কিছুটা হতাশা লক্ষ্য করা গেছে। “বর্তমানে আমাদের পরিবারগুলো বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত।” এই সমস্যার তালিকা অনেক লম্বা। তার মধ্যে যেমন- বৈবাহিক জীবনে অমিল-অবিশ্বস্থতা, যৌনাচার, ভোগবাদ, আপেক্ষিকতাবাদ, মাদকাসক্তা, লেখা পড়ায় অমনোযোগী, বিশৃংখলা, অশান্তি, অন্যের প্রতি অবজ্ঞা, নারী মর্যাদার অভাব, ইত্যাদি। এতো সব সমস্যা ছাড়াও, একালে সামাজিক মিলন ও সংহতি কমে গেছে। যেমনটি পত্রে বলা হয়েছে, “পূর্বের ন্যায় এখন সমাজের লোকেরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও পারিবারিক মিলন মেলায় সমবেত হয় না।” এসব নানাবিধ সমস্যা থেকে রেহাই পেতে হলে “পরিবারগুলোতে আরোও পালকীয় সেবা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এই সেবাকাজ শুধু যাজক ও ধর্মব্রতীদের নয়- পরিবারগুলোকেই সক্রিয় হতে হবে। “পরিবারগুলোকে উন্মুক্ত হয়ে অন্য পরিবারকে সাহায্য করার মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের পরিবারে মিলন গড়ে তুলে তাদের হতে হবে পরিবারের জন্য পরিবার।” সাধু পোপ জনপল বলেছেন, “পরিবার হলো জীবন ও প্রেমের সমাজ- যা গোটা সমাজকেই রূপান্তরিত করতে পারে।”
সমাজকে রূপান্তর করতে হলে ভালো সামাজিক নেতৃত্বেরও প্রয়োজন। আজকের সামাজিক নেতৃত্বের মধ্যে স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব, অবিচার-অন্যায় ও অদক্ষতার বিষয়টি দেখা যাচ্ছে। সামাজিক প্রচেষ্টায়, “নেতৃত্বকে খ্রিস্টীয় আদর্শে গড়ে তুলতে হবে” যার মূলমন্ত্র হবে, “তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসো।”
জাতিসত্তা হিসেবে “সংষ্কৃতি” ভিন্ন হলেও “যিশুর শিক্ষা অভিন্ন।” সংস্কৃতি যদি “যিশু ও মণ্ডলির শিক্ষা বাঁধাগ্রস্ত করে তাহলে সেই সংষ্কৃতি বা রীতিনীতি খ্রিস্টানরা পালন করতে পারে না।” পত্রে যথার্থই বলা হযেছে, “মঙ্গলসমাচার ও মণ্ডলির আইন খ্রিস্টানদের কাছে সকল আইনের উর্ধ্বে।”
মণ্ডলিতে “সংলাপ” চর্চা “পারস্পরিক ভালোবাসা প্রকাশেরই একটি মাধ্যম।” সামাজিক শ্রেণি, জাতিগোষ্ঠী- “সকলের মধ্যে থাকতে হবে সংলাপ ও সংহতি।” প্রতিটি গ্রামে, এলাকায় “ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় সমাজ” গড়ে তুলে সংলাপের মাধ্যমে ভালোবাসা, ধ্যান-ধারণা আদান-প্রদান করতে হবে। অর্থপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে পরিবারে, সমাজে গড়ে ওঠতে পারে উত্তম বোঝাপরা ও মজবুত খ্রিস্ট মণ্ডলি।
আগামী ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ হবে “খ্রিস্ট জুবিলি” বছর এবং পালিত হবে “খ্রিস্টজন্মের ২০২৫ বর্ষপূর্তি উৎসব।” আমরা এখন খ্রিস্টজন্মের ২০২৫ বর্ষপূর্তি উৎসব পালনের প্রত্যাশায় “আশার তীর্থযাত্রী।” খ্রিস্ট আমাদের বিশ্বাস করতে বলেছেন, চাইতে বলেছেন, খুঁজতে বলেছেন, দরজায় আঘাত করতে বলেছেন- খ্রিস্ট বলেছেন, “তা তোমাদের দেওয়া হবে।”
সবশেষে আবারোও বলা যায়- মিলন সাধনা : অর্ন্তভূক্তি ও সংহতি; সিনোডাল বা মিলনধর্মী মণ্ডলি যা ভক্তদের মধ্যে গড়ে তুলবে মিলন; অংশগ্রহণ ও প্রেরণ দায়িত্ব ও থাকবে তার মধ্যদিয়ে একত্রে পথ চলার অঙ্গীকার। মণ্ডলি হয়ে উঠবে পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলন ও মানুষের মধ্যে একতার চিহ্ন। পরিবার-গৃহ মণ্ডলি; খ্রিস্টীয় আদর্শে সামাজিক নেতৃত্ব; সংস্কৃতি; সংলাপ চর্চা; আশার তীর্থযাত্রা-খ্রিস্ট জুবিলি। এসব মিলনে একাত্ম হয়ে- হয়ে উঠতে পারে “একত্রে পথ চলা” ও একটি “আদর্শ খ্রিস্ট মণ্ডলি।”