গত জুলাই মাসের শুরু থেকে বাংলাদেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারী চাকুরীতে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবী ছিল যেন প্রচলিত কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে মেধাবীদের চাকুরীতে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ প্রচলিত কোটা পদ্ধতিতে কোন কোন কোটায় অতিরিক্ত প্রাধান্য ছিল। শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতির বাতিল চায় নি, বরং সরকারের কাছে তারা এটাকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে দাবী জানিয়েছিল, যা ছিল ন্যায্য দাবী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। আমরা শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ ও বৈষম্য-বিরোধী আন্দোনের সংবেদনশীল ও সমর্থক। অনেক কালক্ষেপন ও নাটকীয়তার পরে, হাই কোর্টের আপিল বিভাগ ঘুরিয়ে, শেষ পর্যন্ত সরকার কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে শিক্ষার্থীরাসহ সকলেই সন্তুষ্ট হয়। কিন্তু এর পরপরই শিক্ষার্থীদের এই শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলনের উপর ভর করে কোন এক স্বার্থান্বেষী মহল ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ও সরকারী কার্যালয়ে এক বিভৎস ও নারকীয় ধ্বংশযজ্ঞ চালায়। দেশের জন্য তা বিপুল ক্ষতি বয়ে আনে। এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আমরা সমর্থন করতে পারি না। এইগুলি আমাদের দেশের সম্পদ, এবং তাই দেশপ্রেমিক কোন নাগরিকেরই এই ধ্বংশাত্বক কাজ করা উচিত নয়।
এই সন্ত্রাসী ও বিধ্বংশী কাজ ঠেকাতে সরকার সশস্ত্রবাহিনীকে তলব করে ও কারফিউ জারি করে। এই সময় শিক্ষার্থীসহ অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়, যা কোন ক্রমেই নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মানুষের জীবন ঈশ্বরের অমূল্য দান এবং কোন যুক্তিতেই কাউকে হত্যা করা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এর পর শুরু হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকর। এই কাজ করতে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসী ভেবে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের সাথে অনেক নিরীহ শিক্ষার্থীদেরও গ্রেপ্তার করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের উপর নিপীড়ন চালায়। ডিবি অফিসে ভোজনের চিত্র দেখিয়ে এক রকম তামাশা করা হয় যা নিন্দনীয়। এতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সকল শিক্ষার্থীরা আবার রাস্তায় নামে এবং কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদেরসহ গ্রেপ্তারকৃত সকল শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়ার দাবী জানাতে থাকে।
শিক্ষার্থীরা বরাবরই বলে আসছে তারা সন্ত্রাসী নয় এবং এই হিন্য ধ্বংশাত্বক কাজের সঙ্গে তারা জড়িত নয়। সরকারও এইভাবে বলে আসছে এই অগ্নি-সন্ত্রাস ও ধ্বংশাত্বক কাজের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িত নয়। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী শিক্ষার্থীদের রাতের অন্ধকারে ভীতিপ্রদর্শন করে বাড়ী থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে ও যাচ্ছে। এতে পরিস্থিতি ভাল না হয়ে বরং আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষাসমূহ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থায় দেশবাসী আমরা সকলেই উদ্বিগ্ন। আমরা যে কোন মূলেই শান্তি চাই। দেশ যেন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, এটা সকলেই চায়। দেশের উন্নয়ন হোক এটা সবাই চায় – তবে উন্নয়নের প্রথম বিষয় হলো মানুষ, অর্থাৎ মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নয়ন। কারণ উন্নয়ন মানুষেরই জন্য। মানুষ উন্নত না হলে বাংলাদেশের কোন বস্তুগত উন্নয়ন টিকে থাকবে না। দেশের কোন উন্নয়ন যেন নাগরিকদের মানব মর্যাদা ও অধিকারকে ক্ষুন্ন না করে সেই দিকেও লক্ষ্য রাখা একান্ত আবশ্যক।
মনে রাখতে হবে দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের নাগরিক অধিকার রয়েছে এবং তা তুলে ধরার বা প্রকাশ করার অধিকারও রয়েছে। সেই হিসেবে শিক্ষার্থীদের বৈষম্য-বিরোধী কোটা সংস্কার দাবী কোন অন্যায় কাজ নয়। তা পাশ কাটিয়ে যাওয়া বা দমিয়ে রাখা গণতন্ত্রে চলে না। আবার এটাও ঠিক যে, সহিংসতা বা সন্ত্রাস কখনই কোন সমস্যার সমাধান দিতে পারে না; কারণ সন্ত্রাস শুধু সন্ত্রাসেরই জন্ম দেয় এবং যে অস্ত্র ধরে সে অস্ত্রের আঘাতেই মৃত্যুবরণ করে। সন্ত্রাস যেই করুক তা সন্ত্রাসই – সাধারণ মানুষ সন্ত্রাস করলে অনৈতিক আর সরকার করলেও তা অনৈতিক। তাই সন্ত্রাস বা সহিংসতা শান্তি স্থাপন করতে পারে না। বরং সহিংস ও পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষী না হয়ে সংলাপ ও ভালবাসা দিয়ে পরস্পরকে গ্রহণ করতে পারাই শান্তির একমাত্র পথ। সকল ধর্মই এই শিক্ষা দেয়। আমরা আশা করব যে, দেশের এই অবস্থায় এই সমস্যার সকল পক্ষই শান্তির পথ ধরবেন। বাংলাদেশের মানুষ সেই অপেক্ষায়ই আছে।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও