হিব্রুদের কাছে পত্রে সুন্দরভাবে বলা আছে যে, যাজকগণ দেহ-রক্তে গড়া পরিপূর্ণ একেকজন মানুষ, তাদের বিভিন্ন দোষ-দূর্বলতা ও সবলতা রয়েছে। এত দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও ঈশ্বর তাঁর অপরিসীম দয়ায় মানুষের মধ্য থেকেই যাজকদের বেছে নেন যেন তারা ঈশ্বর ও মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে। তাই বলা হয় যে, যাজকগণ নিজেদের যোগ্যতা বলে নয় বরং পরমেশ্বরের অসীম কৃপায় যাজক পদে অভিষিক্ত হন। “প্রতিটি মহাযাজক মানুষের মধ্য থেকেই মনোনীত হন” (হিব্রু ৫:১)। একজন অভিষিক্ত যাজক মানুষকে আধ্যাত্মিক পথ দেখানোর মাধ্যমে স্বর্গের পথ দেখান। তিনি নিজে পবিত্র থেকে মানুষকে পবিত্রতার পথে চালিত করেন। তাই মণ্ডলীতে যাজকদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পরিবারের কোন সন্তান যখন যাজক পদে অভিষিক্ত হন তখন শুধু সেই পরিবারের সদস্য-সদস্যাগণই নয় বরং গোটা গ্রাম তথা গোটা ধর্মপল্লীতেই আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। তারা ঐশ আশির্বাদে ধন্য হয়ে ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।

গত ১৭ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে বিকালে ডিকন মুকুট গ্রেগরী’র মঙ্গল কামনা করে আশির্বাদের অনুষ্ঠান পবিত্র ঘন্টা করা হয়। এই আশির্বাদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ও ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার ফাবিয়ান মারাণ্ডীসহ অন্যান্য ফাদার-সিস্টারগণ ও ধর্মপল্লীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত খ্রিস্টভক্তগণ।

১৮ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ডিকন মুকুট যাজকপদে অভিষিক্ত হন। অভিষেক অনুষ্ঠানের পবিত্র খ্রিস্টযাগে প্রধান পৌরহিত্য করেন রাজশাহী  ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও। পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে আগত ৪৫ জন ফাদার, ৫ জন ডিকন, ৪৬ জন সিস্টার ও প্রায় ১৩০০ খ্রিস্টভক্ত।

রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ জের্ভাস রোজারিও উপদেশ বাণীতে বলেন- আমরা আজ একজন নতুন যাজক পেতে যাচ্ছি। ঈশ্বর নিজেই যাজক প্রার্থী হিসেবে বেছে নেন, মনোনয়ন এবং অভিষিক্ত করেন। ঈশ্বর নিজেই মুকুটকে বেছে নিয়েছেন। এখন থেকে মুকুট আর কারো নয় বরং তিনি ঈশ্বরের। যাজক হিসেবে যিশুর স্থানে থেকে কাজ করবেন। আমাদের যাজকগণ মানুষ তাই তারাও পাপ করতে পারে। ধার্মিক মানুষ পাপ করে তবে তারা উঠে দাঁড়ায়। তার প্রথম ও প্রধান পরিচয় হচ্ছে যাজক। যাজক হিসেবে জনগণকে পরিচালনা করবেন, শিক্ষা দিবেন। সে যাজক এবং পালক। তাই তাকে বিশপের হয়ে ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তারের জন্য কাজ করবেন। যাজক পালক, শাসন কথা, ও প্রবক্তা অর্থাৎ শিক্ষা দাতা। এর মধ্য দিয়ে ভক্ত জনগণকে পবিত্রতার দিকে নিয়ে যাওয়া। আমরা তার জন্য প্রার্থনা করব যেন সুন্দরভাবে তার যাজকীয় সেবা দায়িত্ব পালন করতে পারে।

পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারির পরিচালক ফাদার পল গমেজ সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, শুরুতে আমার ভালো লেগেছে একজন বয়স্ক লোকের কাছ থেকে যাজকীয় জীবন সম্পর্কে শুনতে পেয়ে। এ বছর ৭জন যাজক পাব। সবকিছুর মধ্যেই বিশপের হাত আছে। নবভিষিক্ত ফাদার মুকুট গ্রেগরী’র মধ্যদিয়ে আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ একটা বিরাট আশির্বাদ লাভ করেছেন। সব কিছু বাদ দিলে প্রার্থনা বাদ দেয়া যাবে না। ফাদার মুকুটের জন্য আজকে আমার বিশেষ বাণী হলো- ফাদার মুকুট মনে রেখো যাজকীয় জীবনে অনেক কিছু বাদ পড়লেও প্রার্থনা জীবন থেকে কখনো অব্যাহতি দেয়া যাবে না।

নব অভিষিক্ত ফাদার মুকুট গ্রেগরী তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন- আজকের এই আনন্দঘন অনুষ্ঠানে সকলকে জানাই শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা। পরিবারে আমার অবস্থান তৃতীয়। আমরা ৪ ভাই ছিলাম, বর্তমানে ৩ ভাই। আমি আজ সত্যিই আনন্দিত। অনেক প্রতীক্ষার পর এলো এই দিন, স্বপ্নের মতো হয়ে রঙ্গে রঙ্গীন এই গানের মতো আমার জীবনের যে স্বপ্ন ছিল তা আজ পূরণ হয়েছে। ঈশ্বর আমাকে তাঁর দ্রাক্ষাক্ষেত্রে কাজ করার জন্য অভিষিক্ত করেছেন। আমি যাজক পদে অভিষিক্ত হয়ে আজ নিজেকে অনেক ভাগ্যবান বলে মনে করছি। কারণ দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে ও নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আমি আজ আমরা স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। “যখনই ডেকেছি, তুমি তো দিয়েছ সাড়া; নতুন শক্তি দিয়েছ আমার প্রাণে” (সামসঙ্গীত ১৩৮:৩)। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও’কে যিনি আমাকে যাজক হওয়ার জন্য অনুমতি দিয়েছেন এবং আমাকে যাজক পদে অভিষিক্ত করেছেন। আজ আমি যে বিশেষ দায়িত্ব লাভ করেছি তা যেন আজীবন পবিত্র থেকে পালন করে যেতে পারি। “আমার পিতা যেমন পবিত্র তোমরাও তেমনি পবিত্র হও”  (মথি ৫:৪৮)। আমার জন্য সকলেই প্রার্থনা করবেন আমি যেন সর্বদা পবিত্র থেকে বিশ্বস্তভাবে আমরা এই যাজকীয় কাজ করতে যারি। আমি একান্তভাবে আপনাদের প্রার্থনা ও আশির্বাদ কামনা করি।

নব অভিষিক্ত ফাদার-এর মা তেরেজা বিশ্বাসের অনুভূতি- আমার সন্তান যাজক পদে অভিষিক্ত হতে যাচ্ছে, আমি ভীষণ আনন্দিত ও উল্লসিত। এই দিনটির জন্য আমি অনেক দিন অপেক্ষায় আছি। আমি নিশ্চয়ই কোনো ভালো কাজ করেছি। তাই তো ঈশ্বর আমার সন্তানকে যাজক পদে আহ্বান করেছেন। ঈশ্বরের দ্রাক্ষাক্ষেত্রে কাজ করবে, সকলের সেবা করবে এটি আামি চাই। আমি প্রার্থনা করি সে সুস্থ থেকে তার দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে যেতে পারে। তার মাধ্যমে সকলের উপর যেন ঈশ্বরের আশির্বাদ বর্ষিত হয়। সে যেন বিশ্বাসের পথে অটল থেকে যাজকরূপে কাজ করে যেতে পারে। আজ তার বাবা বেঁচে থাকলে তিনিও খুব খুশি হতেন। তিনি নিশ্চয়ই স্বর্গ থেকে তাকে দেখছেন।

স্কুল শিক্ষক মনিকা ঘরামী যাজক অভিষেক অনুষ্ঠানে তার অনুভূতিতে বলেন- একে একে অনেক বছর পার করে আজ মুকুট তার অভীষ্ট লক্ষ্য তথা যাজক হয়ে ঈশ্বর ও মানুষের সেবা করার ব্রত গ্রহণের সেই মহতীক্ষণে এসে  উপস্থিত। সহসাই আমার হৃদয় মন আজ গভীর আনন্দে পুলকিত আর সানন্দে গেয়ে উঠেছেঃ “ভগবানের জয়ধ্বনি কর নিখিল ধরণী ভগবানের সেবাকর, পুলকিত প্রাণে  আনন্দের গান গেয়ে এসো এসো তার শ্রীচরণে; আহা ভগবান কত না মঙ্গলময় তিনি, আহা তাঁর সেই দয়া, সে তো সেই চিরন্তন; নিত্যই জাগ্রত তাঁর বিশ্বস্ততা যুগে যুগে কালে কালে।” (সাম-১০০) আমাদের সন্তান আমাদের গৌরব ও গর্ব। নব অভিষিক্ত যাজক মুকুটের জন্য অনেক অনেক আশির্বাদ ও প্রার্থনা রইল যেন, সে ঐশ প্রজ্ঞা জ্ঞান ও শক্তিতে বলিয়ান হয় এবং নিষ্ঠার সঙ্গে পবিত্র  থেকে ঈশ্বর, মণ্ডলী ও মানব সেবা করে যেতে পারে।

প্যারিশ  কাউন্সিলের সহ-সভাপতি মি: ফ্রান্সিস সরেন তার অনুভূতিতে বলেন- যাজক হওয়ার জন্য একজন যুবককে প্রায় ২৬টা বছর পড়াশুনা করতে হয়, অর্জন করতে হয় বিদ্যা, জ্ঞান, ত্যাগ তিতিক্ষা, আত্মোৎসর্গ, ভালবাসার হৃদয়। একজন যাজকের ক্ষমতা তার হৃদয়ে, জনগণের হৃদয় জয় করতে পারলেই তার আনন্দ। এসব অর্জন করতে হলে নিবিষ্টচিত্তে প্রভু পরমেশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে হয়। আজকে আমি খুবই আনন্দিত, পুলকিত যে একজন যাজক পেলাম। ক্যাথিড্রাল কাছাকাছি গ্রামগুলো থেকে ৩ জন যাজক পেলাম। যা প্রভু পরমেশ্বর আমাদের প্রতি যত্ন নিয়েছেন।

পাল পুরোহিত ফাদার ফাবিয়ান বলেন, যাজকত্ব হলো যিশু হৃদয়ের ভালোবাসা ও ঈশ্বরের একটি অমূল্য ভালোবাসার দান। সেই অমূল্য আহ্বানে সাড়া দিয়ে ডিকন মুকুট গ্রেগরী বিশ্বাস যাজকীয় অভিষেক লাভ করেছে। তাই আজ আমি অত্যন্ত আনন্দিত। ঐশ অনুগ্রহের এই শুভ সময়ে কৃতজ্ঞ অন্তরে তাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। প্রার্থনা, উৎসাহ-অনুপ্রেরণা ও সমর্থন দিয়ে তার সাথে সামনে চলার পথযাত্রী হওয়ার জন্য তার পরিবারের সবাইকে তথা রাজশাহী উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর সকল খ্রিস্টভক্তকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। যাজক অভিষেক ঘিরে যারা নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন বিশেষভাবে পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ মহোদয়সহ, সকল ফাদার-সিস্টার ও ব্রাদারগণ, ধর্মপল্লীতে কর্মরত সহকারি পাল-পুরোহিত ফাদার শ্যামল গমেজ, ফাদার লিটন কস্তা, পালকীয় পরিষদের সকল সদস্য-সদস্যাবৃন্দ এবং বিভিন্ন কমিটিতে থেকে যারা আজকের এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন বা করছেন তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ, তাদের সবার প্রতি রইল অনেক শুভ কামনা। ঈশ্বরের আশির্বাদে ডিকন মুকুট গ্রেগরী বিশ্বাস একজন পবিত্র ও বিশ্বস্ত যাজক হয়ে উঠুক এবং নবসন্ধির মহাযাজক যিশুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে হৃদয়ের বিশ্বাস ও দয়ার সেবাকাজে মণ্ডলীতে ও ভক্তজনগণের মাঝে অপরখ্রিস্ট হয়ে উঠুক এই প্রার্থনা ও শুভ কামনা করি।

বরেন্দ্রদূত নিজস্ব রিপোর্টার

Please follow and like us: