পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসের জলবায়ু সংকট বিষয়ক ‘ঈশ্বরের (LAUDATE DEUM) প্রৈরিতিক পত্রটি বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। পৃথিবীতে একটাই আলোচনা, একটাই কথা ‘জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে হুমকির সম্মুখীন আজ সারা বিশ্ব। এই হুমকি মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং খ্রিস্টমন্ডলীকে একযোগে দাঁড়াতে হবে বিপর্যয় রুখতে।
পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশ চিন্তিত। ইতিমধ্যে তিনি বিশ্বের কাছে জলাবায়ু বিষয়ক দুটি প্রৈরিতিক পত্র ‘লাউদাতো সি এবং ‘লাউদাতো দেউম লিখেছেন। এছাড়াও আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের প্রকৃতি প্রেমের সাথে একাত্ম হয়ে পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস তার ধ্যান-অনুধ্যান, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টি পৃথিবীকে রক্ষায় সবাইকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্যাতনের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন দেখা যায়। প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ু ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হলেও মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট কারণকেই মূল কারণ হিসেবে দেখা হয়। মানুষ যে জলবায়ু পরিবর্তন করছে, এ বিষয়ে বেশ শক্ত প্রমাণ আছে। আর এ প্রক্রিয়াটি মানুষ সম্পাদন করছে গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদনের মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং মিথেনের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদন করে।
শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ক্রমাগত অধিকহারে শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্যাস নির্গমনের ফলে বায়ুমন্ডলের উত্তাপ বেড়ে চলেছে, যার জন্য দায়ী মানুষই। কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি, জমি ব্যবহারে পরিবর্তন, বৃক্ষনিধন, বন উজাড়, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, মিথেন গ্যাস নির্গমন ও কৃষি প্রভৃতি কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ভয়ঙ্কর এই পরিণতি ঠেকানোর আর কোন উপায় নেই এবং চলতি শতকের শেষে গিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তাহলে এর প্রভাব বিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম হবে। ইতিমধ্যে আমরা পৃথিবীর দিকে তাকালে সে চিত্রগুলো দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা, অনাবৃষ্টি, খরা ও অতিবৃষ্টি সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় তাই শীর্ষে অবস্থান করছে। এছাড়াও বিগত কয়েক সাপ্তাহ ধরে পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা প্রথম স্থানে আছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে নানা রকম প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমান্বয়ে হৃাস পাচ্ছে। অনেক প্রকৃতি থেকে অনেক প্রজাতি হারিয়ে যেতে বসেছে। গাছ, মাছ, পাখি, ফুল, ফল সবকিছুতেই এই প্রভাব পড়ছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের জন্য যেখানে ছিল যথাযোগ্য তাপমাত্রা, ছিল ছয়টি আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ঋতু, সেখানে দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতু হারিয়ে যেতে বসেছে এবং সঙ্গে বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রায় আমূল পরিবর্তন আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। শ্বাসকষ্ট, হিটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা ঠান্ডাজনিত মৃত্যু এখন খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের ফলে আমাদের বসতবাটি এই পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে তা নিরাময়ে আমাদের কাজ করা দরকার। পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের জীবনের অনুকরণে বিশ্বের সবাইকে প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হবার আহ্বান জানিয়ে এই প্রৈরিতিক পত্রের মধ্য দিয়ে বলেন, ‘পরিবেশের বর্তমান দূরাবস্থা ও বিপর্যয়ের মূল কারণ মানুষ। পরিবেশের কথা না ভেবে মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিল্প ও বানিজ্যের কথা ভেবেছে। ফলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’ পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষা ও রূপান্তরের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি হিসেবে পোপ ফ্রান্সিস ‘সমন্বিত পরিবেশ অর্থাৎ পরিবেশকে সমন্বিতভাবে দেখা ও অন্তরের পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন।
৪ অক্টোবর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে, আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের পর্বদিবসে রোমের লাতারানে সাধু যোহনের বাসিলিকায় পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসের ‘ঈশ্বরের প্রশংসা (LAUDATE DEUM) প্রৈরিতিক পত্রটি প্রকাশিত হয়। প্রৈরিতিক পত্রটি সবার পড়ার সুবিধার্থে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। পোপের এই অনুপ্রেরণামূলক পত্রটি অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে সবাই নিজস্ব পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রতিবেশীকে রক্ষায় এগিয়ে আসবেন বলে আশা রাখি। (চলমান)
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ