ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ প্রতি বছর ১ জানুয়ারি, বিশ্ব শান্তি দিবস উপলক্ষে শান্তির বাণী দিয়ে থাকেন। ইতিমধ্যেই পোপ ফ্রান্সিস ২০২০ খ্রিস্টাব্দের শান্তি দিবস উপলক্ষে তাঁর বাণী দিয়েছেন। পোপের বিশ্ব শান্তি দিবসের বাণীর সারকথা ও আলোচনা তুলে ধরা হলো।
পোপ ফ্রান্সিস ৫৩তম বিশ্ব শান্তি দিবসের বাণী শুরু করেন, শান্তির বাণী দিয়েই। তিনি বলেন, আশাই আমাদের শান্তির পথে ধরে রাখে। অন্যদিকে, অবিশ্বাস ও ভয় সম্পর্ক দুর্বল করে- সেই সাথে সহিংসতার ঝুঁকি তৈরি করে। পোপ অনুরোধ করছেন- শান্তির শিল্পী হওয়ার জন্যে, যেনো পুর্ণমিলনের আলোকে সংলাপ স্থাপন ক’রে পরিবেশ দূষণমুক্তের যাত্রায় জীবনকে নতুনরূপে দেখার লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া যায়। আশাই আমাদের সামনে চলার পথ দেখায়। অন্যদিকে মানব ইতিহাস থেকে জন্ম নেওয়া যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ এখনো দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্থ ক’রে দুঃখ ও অন্যায্যতাকেই উৎসাহিত করে তুলছে।
একমাত্র ভ্রাতৃপ্রেম মানবতার সহজাত আহ্বান হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ভ্রাতৃপ্রেমের বদলে দেখা যায় লাগাতারভাবে নিজ স্বার্থ-সাধন, দুর্ণীতি সেই সাথে ঘৃণা, যা সহিংসতা সৃষ্টি করছে। প্রতিদিনই নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মর্যাদা, স্বাধীনতা, সহমর্মীতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ভবিষ্যতের আশা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। পোপের ভাষায়, প্রতিটি যুদ্ধ ভ্রাতৃহত্যার শামিল এবং যা মানব পরিবারের সহজাত ভালোবাসার আহ্বানকে বিনষ্ট করে।
যুদ্ধ কেনো হয়? প্রায়ই দেখা যায়, মানব সমাজ বা অন্য জাতির মধ্যে যে বৈচিত্রতা রয়েছে সেটাকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে নিজের মধ্যে আত্ম-গরিমা, স্বার্থপরতা ও হিংসা-ঘৃণা জমতে থাকে, সেটাই একসময় যুদ্ধের রূপ ধারণ করে। ভ্রাতৃপ্রেম সম্পর্কে পোপ বলেন, ভ্রাতৃপ্রেমই মানুষকে সংলাপ ও পারস্পরিক বিশ্বাসের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। অন্যদিকে অবিশ্বাস মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন দুর্বল ক’রে- সবল করে তোলে সহিংসতা এবং যা একসময় মানব সম্পর্ক ও শান্তিকে কলুষিত করার পথে এগিয়ে দেয়। পোপ মনে করেন, আজকে মানুষে-মানুষে যে অবিশ্বস তা মোচন করা সম্ভব- কেবলমাত্র উত্তম ভ্রাতৃপ্রেম এবং একই ঈশ্বরকর্তৃক সৃষ্ট জীব হিসেবে আস্থা রেখে, সংলাপ ও বিশ্বাসের চর্চা করার মধ্যদিয়ে। তিনি বলেন, মানুষকে আন্তরিকভাবে স্মরণে রাখতে হবে যে, শান্তির তাগিদটা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে বিদ্যমান। সুতরাং শান্তি স্থাপনের আবেদন থেকে নিজেকে কিছুতেই প্রত্যাহার করে নেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এইসব ক্ষেত্রে অতীত থেকেও মানুষকে শিক্ষা নিতে হবে। পোপ বলেন, পারমানবিক অস্ত্রের আঘাত থেকে যারা বেঁচে গেছেন, তারা শান্তি স্থাপনের জন্য আজোও স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছেন। অনেক ক্ষেত্রে অতীত হয়ে যাওয়া গঠনা থেকে উদ্ভূত অভিজ্ঞতার ফল বর্তমান এবং ভবিষ্যতের শান্তির বাহক হয়ে ওঠে।
পোপ ফ্রান্সিস মনে করেন, বিশ্বে শান্তি স্থাপনের যাত্রাটা; মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, মানুষের নিজস্ব আগ্রহ, সমাজ ও জাতির কারণে আরো জটিল ও সংঘাতময় হয়ে উঠছে। শান্তির তাগিদটা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে বিদ্যমান, পোপ বিষয়টি আবার উল্লেখ করে বলেন, মানুষের মধ্যে যে রাজনৈতিক ইচ্ছা রয়েছে তারও নবায়ন দরকার, যেনো মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে, নতুনভাবে পুর্নমিলন ঘটে। পোপ প্রতিটি মানুষকে শান্তির শিল্পী হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়ে, সম্মিলিতভাবে শান্তির পথে, সবার স্বার্থে এবং বিরামহীনভাবে সামনে চলার অনুরোধ করেন। তাঁর মতে, “আমাদের পক্ষে সত্যিকার অর্থে শান্তিলাভ সম্ভব নয়, যতোক্ষণ নারী-পুরুষ সংলাপের মধ্যদিয়ে, শুধুমাত্র অলীক ধারণা ও নানাবিধ মতামতের উর্ধ্বে পৌঁছাতে না পারেন।” আজকের বিশ্বে শুধুমাত্র কথার প্রয়োজন নেই- প্রয়োজন শান্তির দূত, স্বাক্ষ্যদাতা, যারা নিজ স্বার্থ-সাধন পরিহার ক’রে সংলাপ শুরু করতে পারেন। প্রতিটি মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের দেওয়া যে নানাবিধ সামর্থ রয়েছে, মানুষকে সেই সামর্থ দিয়েই শান্তি স্থাপনের যাত্রায় শামিল হতে হবে।
পরিবশে বিপর্যয় নিয়ে পোপ তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ ক’রে বলেন যে, মানুষকে পরিবেশবান্ধব হতে হবে। আজকে প্রকৃতির মধ্যে যেসব বৈরী স্বভাব দেখা যায় তার সমস্ত কারণ- মানুষের কারণে। আমাদের ক্ষণকালীন লোভ-লাভের কারণে, প্রকৃতির সম্পদকে দুষিত ক’রে নিজের ঘরকেই দুষিত করে তুলছি। পোপ আমাজন সিনোদ উল্লেখ করে বলেন, “ভূমির সঙ্গে মানবগোষ্ঠীর থাকতে হবে একটি শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক, একটা অতীত-বর্তমান সম্পর্ক, অভিজ্ঞতা ও আশার সম্পর্ক।”
পোপ, শুভ-চিন্তার নারী-পুরুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, আপনারা “নিজের অন্তর থেকে অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তারলাভ থেকে দূরে থাকুন, বরং ঈশ্বরের সন্তান ভেবে সবাইকে ভাই-বোন হিসেবে গ্রহণ করুন।” তিনি বলেন, পিতা ঈশ্বরের দেওয়া মহান কৃপা মানুষের মধ্যে রয়েছে, যে কৃপার দ্বারা মানুষ স্বার্থহীন ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, একে অন্যের জন্য শান্তি উৎসর্গ করতে পারেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পবিত্র আত্মা সেভাবেই অনুপ্রেরণা দান করে থাকেন, যাতে আমরা শান্তি শিল্পী হয়ে ওঠতে পারি। পাঠকদের প্রতি রইলো বড়দিন ও খ্রিস্টিয় নববর্ষের শুভেচ্ছা। ফাদার সুনীল রোজারিও
পোপের শান্তি দিবসের বাণী- ২০২০
Please follow and like us: